পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বাতিল ২৪২ কোটি টাকার দরপত্র পুনর্বহালের চেষ্টা
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী
জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি মজুতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট দীর্ঘদিনের। এ সমস্যা কাটাতে গত বছর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ২৪২ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করে। তবে কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে সেটি বাতিল করা হয়। এখন একটি চক্র সেই বাতিল দরপত্র পূনর্বহালের পাঁয়তারা করছে। পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। এমনকি আইনবহির্ভূত অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, একবার দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর পুনঃদরপত্র আহ্বান না করে আগের দরপত্র পুনর্বহালের সুযোগ নেই। এটি আইনবহির্ভূত। পুনঃদরপত্রের আহ্বান ছাড়া আগের দরপত্র নিয়ে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন (দরপত্র পুনর্মূল্যায়ন) কমিটি কোনোভাবেই বৈঠক করতে পারে না।
জাতীয় ক্রয়নীতি ২০০৬ এর ১৯.১ সেকশন অনুযায়ী টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি ও ক্রয় কমিটি সরবরাহকারীকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (কার্যাদেশ) না হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কোনো প্রয়োজনে দরপত্র বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। যদি একবার দরপত্র বাতিল হয় তাহলে নতুন দরপত্র আহ্বান ছাড়া আগের দরপত্রে কোনোভাবেই কেনাকাটার সুযোগ নেই। বাতিল হওয়া দরপত্র পুনর্বহালের চেষ্টা করাও বেআইনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মুখে খাওয়ার পিলের (খাবার বড়ি) মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পোর্টাল) জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বর্তমানে দেশের প্রায় ৩৮টি উপজেলায় মুখে খাওয়ার পিল বড়ি মজুত শেষ। এই সংকট নিরসনে জরুরিভিত্তিতে মুখে খাওয়ার পিল কেনাকাটার উদ্যোগ নেয় সরকার।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২ জানুয়ারি পাঁচটি লটে প্রায় ২৪২ কোটি টাকার বেশি উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। সাতটি কোম্পানি সেখানে দরপত্র জমা দেয়। তবে মাত্র তিনটি কোম্পানি দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারে। ১, ২ ও ৩ লটে দরপত্র জমা দেয় বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি রেনেটা লিমিটেড ও টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। আর ৪ ও ৫ লটে শুধু মাত্র পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড শর্ত পূরণ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩ মার্চ টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি (দরপত্র পুনর্মূল্যায়ন) কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে এই পাঁচটি লটের দরপত্র বাতিল করে দেয়। এমনকি দরপত্রে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কোম্পানিগুলো ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা তুলে নেয়। সেই সময় এই টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেগম সাহান আরা বানু।
তার চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় মার্চে তিনি অবসরে যান। তারপর এই পদে মহাপরিচালক হিসাবে আসেন আ ন ম আল ফিরোজ। অভিযোগ উঠেছে, বাতিল হওয়া দরপত্র পুনর্বহাল করতে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহামুদ ফোন করে আ ন ম আল ফিরোজকে দরপত্র পুনঃজাগরণের অনুরোধ করেন। একটি বিশেষ কোম্পানিকে সুবিধা দিতে সুপারিশ করেন তিনি।
আ ন ম আল ফিরোজ মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন দফায় টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটির বৈঠক করেন। সব বৈঠকে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সবশেষে বেআইনিভাবে এই দরপত্র অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হেড প্রকিউরমেন্ট অথরিটি কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ব্যাপক রদবদল দেখা যায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় ২ সেপ্টেম্বর আ ন ম আল ফিরোজকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
জানতে চাইলে সদ্য ওএসডি হওয়া মহাপরিচালক আ ন ম আল ফিরোজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
তিনি জানান, ‘সাহানারা ম্যাডাম (বেগম সাহান আরা বানু) ডিজি থাকাকালে দরপত্রটি বাতিল করেন। পরে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) জানায় এটি বাতিল হয়নি। সিপিটিইউ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের একটি স্থায়ী সংস্থা, যার মাধ্যমে সরকারের ক্রয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা হয়ে থাকে। এটা আমার সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। এখন মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল পার্সেস কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে। তাছাড়া এ সংক্রান্ত কাগজপত্র অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখানে নির্ধারিত শাখায় যোগাযোগ করলে সব জানা যাবে। তিনি আরও জানান, শুনেছি আমি আসার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফের মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ও জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, যেটা আগের ডিজি বাতিল করে গেছেন, আরেক ডিজি এসে রাতের আঁধারে সেটা পুনর্বহাল করবেন এটা ঠিক নয়। যেহেতু আগের দরপত্র বাতিল হয়েছে, এখন উচিত নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা। যারা টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলেন তারা ফের অংশ নেবেন। যোগ্যতা থাকলে দরপত্র পাবেন। তাতে করে সমালোচনা থাকবে না। না হলে বুঝতে হবে এখানে একটি মহলের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে।