চিনির ওপর ‘রিয়েল শুল্ক’ ১৫ শতাংশ কমানোর চিন্তা
পেঁয়াজ-আলুর শুল্ক কমার প্রভাব নেই বাজারে
শুল্ক প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে-সভাপতি, ক্যাব
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আলু ও পেঁয়াজ
শুল্ক প্রত্যাহারের পরও বাজারে আলু এবং পেঁয়াজের মূল্যে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। আলু-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম কমবে বলে দেশের মানুষের মনে যে আশা জেগেছিল-তাতে ধুলো জমতে শুরু করেছে। মানুষ তাদের অর্থকষ্টের কারণে বাজারে পণ্যমূল্য কমানোর বিষয়ে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, এখন সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং তাদের ওপর বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জুলুম কমবে।
এদিকে, আলু ও পেঁয়াজের পর এবার কমানো হচ্ছে চিনির ওপর আরোপিত শুল্ক। এক্ষেত্রে ‘রিয়েল শুল্ক’ হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সম্ভাব্য ১৫ শতাংশ নির্ধারণ হতে পারে, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ শুল্ক কমতে পারে। এ ব্যাপারে অর্থ উপদেষ্টার সায় পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানা গেছে। এর পাশাপাশি বাজারে মূল্য কমাতে অন্যান্য নিত্যপণ্যের শুল্ক ও কাস্টমস ডিউটি কাঠামো যৌক্তিকরণ করতে পর্যালোচনা শুরু এনবিআর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে শুল্ক প্রত্যাহারের পরও পেঁয়াজের কেজিতে মাত্র ২ টাকা কমার ঘটনায় বিস্মিত ভোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। এখন চিনির শুল্ক প্রত্যাহারের পর বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে সেটি নিয়ে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর নিত্যপণ্যের মূল্য কমিয়ে আনতে বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে। পরে তিনি নিত্যপণ্যের বিদ্যমান শুল্ক ও কাস্টমস ডিউটি যৌক্তিকরণসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এরমধ্যে আরও রয়েছে-বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ও এলসি খোলার ‘এড কনফার্মমেশন’ ফি হ্রাস ও ব্যবসায়ীদের একক ঋণ সীমা বৃদ্ধি। এছাড়া অত্যাবশকীয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহমুখী শিল্পে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহও রয়েছে এই তালিকায়।
সূত্র জানায়, বাণিজ্য উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে ইতোমধ্যে আলু আমদানিতে ১৩ শতাংশ, কীটনাশকে ২০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস এবং পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক) প্রত্যাহার করা হয়। এখন চিনি আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনবিআর।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান প্রতি টন পরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ৬ হাজার টাকা কাস্টমস ডিউটি, ৩০ শতাংশ রিয়েল ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্যাক্স এবং ৫ শতাংশ এআইটি আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতি টন পরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ৬ হাজার টাকা কাস্টমস ডিউটি আদায় করা হয়।
দেশীয় চিনিশিল্পকে রক্ষায় এই বাড়তি শুল্কহার আরোপ করা হলেও তা বছরের মোট চিনির চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ পূরণ করছে। বাকি ৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। আর ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন চিনির জোগান আসে দেশি শিল্প থেকে। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভ্যাট ও শুল্ক থাকায় চিনির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। যার খেসারত দিচ্ছে দেশের সব ভোক্তা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সেলের তথ্যমতে, ২৬ সেপ্টেম্বরের হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পরিশোধিত চিনির মূল্য বেড়েছে ৬০ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলার এবং অপরিশোধিত চিনির মূল্য ৪৮ দশমিক ৪২ ডলার। অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর এক টন পরিশোধিত চিনির মূল্য ছিল প্রায় ৫৯৭ মার্কিন ডলার, যা আগের সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৫৩৫ ডলারে। একইভাবে অপরিশোধিত চিনির মূল্য উঠে ৪৯৮ মার্কিন ডলার, যা আগের সপ্তাহে ছিল প্রায় ৪৪০ ডলার। তবে এক মাসের ব্যবধানে চিনির গড় মূল্য বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এরসঙ্গে ভ্যাট ও শুল্ক যুক্ত হয়ে দেশের বাজারে ১২৯ টাকায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, চিনির শুল্ক হার কমানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। পাশাপাশি ডিম আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনা চলছে। তবে এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
দেশে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে হিসাব দেয়, তার চেয়েও মূল্যস্ফীতি বেশি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিবিএস জুলাইয়ের মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রথমবারের মতো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে শুল্ক-কর কমানোর সুফল ভোক্তার বদলে ব্যবসায়ীদের কাছেই যায়। সরবরাহের উন্নতি হবে উৎপাদন ও আমদানি দুটিই বৃদ্ধির মাধ্যমে। এছাড়া চাঁদাবাজি, রাস্তায় জট ও বন্দরে জটও বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং দরকার বাজার তদারকির কাজটি করতে হবে। তখন হয়তো ভোক্তা কিছুটা সুফল পেতে পারে।