প্রশাসনিক অস্থিরতায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার প্রভাব রাজস্ব আদায়ে
আগের সরকারকে খুশি রাখা ও নিজেদের পারফরম্যান্স দেখাতে কর্তারা রাজস্ব আদায়ের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতেন * রাজস্ব কর্মকর্তাদের অসন্তোষের প্রভাব
গত ২ মাসে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক স্থবিরতায় রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে। অর্থবছরের শুরুর ২ মাসে (জুলাই-আগস্ট) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ হাজার ৫১ কোটি টাকা কম আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
যদিও জুলাইয়ে পুরোটা সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন সরকার কারফিউ জারি করে, এতে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ ছিল। আর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। চাকরিতে বৈষম্যের অভিযোগ এনে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। সব মিলিয়ে রাজস্ব প্রশাসনে হযবরল অবস্থা। আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারে যুগ্ম ও অতিরিক্ত কমিশনার পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাওয়া হয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্ট।
অন্যদিকে নতুন কর অঞ্চলগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন-বদলি করা হলেও লজিস্টিকের অভাব ও করদাতাদের ফাইল নতুন সার্কেলে ট্রান্সফার না করায় পদায়নকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে বাসায় বসে অফিস করছেন।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে (জুলাই-আগস্ট) এনবিআরের আওতায় মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আদায় হয়েছিল ৪৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ হাজার ১৭৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আয়কর খাতেও আদায় কম হয়েছে। আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম হয়েছে ৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
এরপরের অবস্থায় আছে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট আদায়। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ ভ্যাট কম আদায় হয়েছে। জুলাইয়ে কারফিউ এবং আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থবিরতা থাকায় ভ্যাট আদায় কমেছে-এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। লক্ষ্য অর্জন পূরণ করতে না পারলেও অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছে আমদানি শুল্ক খাত। গত বছরের তুলনায় এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এক দশমিক ৮০ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে আয়কর খাতে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় এক লাখ ৭৭ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা, ভ্যাট খাতে এক লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং আমদানি শুল্ক খাতে এক লাখ ২৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাণিজ্যিক পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। সে কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের রাজস্ব আদায় কমে গেছে।
তারা মনে করেন, অর্থবছরের বাকি সময়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। তাছাড়া আগে রাজনৈতিক সরকারকে খুশি করতে এনবিআরের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য রাজস্ব আদায়ের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতেন। যে কারণে অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে গরমিল দেখা দিত। এখন যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, তা সরকারের চূড়ান্ত হিসাব ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য তৈরি করা হচ্ছে।
অর্থাৎ এই হিসাব ব্যবস্থায় আদায় বেশি দেখানোর সুযোগ নেই। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ জুলাই-আগস্টে একটা গণঅভ্যুত্থান-বিপ্লব হয়েছে। এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়নি, তবে আগের বছরের কাছাকাছি আদায় হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এনবিআর কাজ করছে।
অসন্তোষ আছে রাজস্ব প্রশাসনে : ১৫ আগস্ট এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পান আব্দুর রহমান খান। কর্মস্থলে যোগ দিয়েই তিনি সদ্য বিদায়ি চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির মুখে পড়েন। মাঠপর্যায়ে কর্মরত নৈশপ্রহরী থেকে শুরু করে ক্যাডার কর্মকর্তারাও পদোন্নতিসহ নানা দাবি-দাওয়া জানান তার কাছে। তিনি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের বঞ্চিতদের পদোন্নতি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুগ্ম ও অতিরিক্ত কমিশনার পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে গোয়েন্দা রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ে অসন্তোষ আছে। অতীতে কখনো এই পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা রিপোর্ট চাওয়া হয়নি। অ্যাডমিন ক্যাডারের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ ধরনের গোয়েন্দা রিপোর্ট না চাওয়ায় পদোন্নতির জ১৪ন্য অপেক্ষমাণ রাজস্ব কর্মকর্তাদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে।
তাছাড়া কাস্টমসের ঢাকা উত্তর বন্ড কমিশনারেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর দীর্ঘদিন ধরে কমিশনার শূন্য রয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর কমিশনার আজিজুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে সদস্য করার পর এই দপ্তরে কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। এর ফলে বড় বড় গার্মেন্টস ও রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। বন্ড কমিশনারেট গার্মেন্ট ও রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে আমদানি প্রাপ্যতা দিয়ে থাকে। ভ্যাট ফাঁকি রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভ্যাট গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরও কমিশনার শূন্য।
অন্যদিকে আয়কর খাতেও হযবরল অবস্থা। নতুন কর অঞ্চলগুলোতে কর্মকর্তা পদায়ন করা হলেও অফিস, লজিস্টিকের অভাবে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না। কর্মকর্তারা বাসায় বসে বা অন্য সহকর্মীর দপ্তরে গল্পগুজব করে সময় পার করছেন। শুধু তাই নয়, অনেক কর অঞ্চলের বেতন কোড হয়নি। এতে করে এসব কর্মকর্তা বেতন নিয়েও চিন্তিত। অক্টোবরে নতুন কর অঞ্চলগুলোতে কর্মকর্তাদের ফাইল আসার কথা থাকলেও এখনো কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি এসব দপ্তর। কবে নাগাদ ফাইল আসবে তাও বলতে পারছে না কেউ। ৩০ নভেম্বর ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের আয়কর রিটার্ন জমার শেষ দিন। এরপর রিটার্ন জমা দিলে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে না-এমন ঘোষণার প্রেক্ষিতে নতুন কর অঞ্চলগুলোর করদাতাদের কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাঠপর্যায়ের আয়কর কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বত্র ভীতিকর পরিবেশ কাজ করছে। দুর্নীতির অভিযোগ ও হয়রানির ভয়ে কেউ স্বাভাবিক কাজ করতে চাইছেন না। এনবিআর ব্যক্তি পর্যায়ে অডিট বাতিল করায় কর্মপরিধি ছোট হয়ে এসেছে। কোম্পানির অডিটও প্রায় বন্ধ। সামগ্রিকভাবে যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, নতুন কর অঞ্চলগুলোকে ফাংশনাল করতে ইতোমধ্যেই অফিস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যেই এগুলোকে ফাংশনাল করা হবে। করদাতাদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। অনলাইনে করদাতাদের রিটার্ন দিতে আমরা উৎসাহিত করছি। তারপরও ফিজিক্যালি কেউ যদি রিটার্ন জমা দিতে চান, তাহলে আগের সার্কেলেই তারা রিটার্ন দিতে পারবেন, যতদিন না ফাইল ট্রান্সফার হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিগগিরই এনবিআর একটি নির্দেশনা জারি করবে।