Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিলুপ্ত ঘোষণার অপেক্ষায় ১৪ দলীয় জোট

গণহত্যার দায় ১৪ দলের ওপর বর্তাতে পারে -সুজন সম্পাদক * ১৪ দল আছে এবং থাকবে -বাহাউদ্দিন নাছিম

রেজাউল করিম প্লাবন

রেজাউল করিম প্লাবন

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিলুপ্ত ঘোষণার অপেক্ষায় ১৪ দলীয় জোট

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১৪ দলীয় জোট থাকার যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন জোটের অধিকাংশ নেতা। তাদের মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা হয়েছে। এ গণহত্যার দায় এড়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট বিলুপ্তি ঘোষণা করা হবে। এছাড়া গত ২০ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে না পাওয়ার হতাশায় সৃষ্ট ক্ষোভ জোট বিলুপ্তির মাধ্যমে বিদায় করতে চান তারা। জোট নেতারা আত্মগোপনে থেকে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, ১৪ দলীয় জোট বিলুপ্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করছেন বলেও জানান নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা যুগান্তরকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৩ দিনের মাথায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। 

‘মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক’ আদর্শের ভিত্তিতে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। সে হিসাবে জোটটির বর্তমান বয়স ২০ বছর। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে মোকাবিলা করতে এ জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। জোটের অন্য দলগুলো হলো-বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ছাড়া বাকি সবারই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন রয়েছে। 

১৪ দলীয় জোটের কমপক্ষে সাতজন নেতা অভিন্ন সুরে যুগান্তরকে জানান, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ১৪ দলের নেতারাও আত্মগোপনে গেছেন। গ্রেফতার হয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (জামিনে মুক্ত)। আবার অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। আওয়ামী লীগের এত দ্রুত পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের পরিস্থিতি বিবেচনায় জোটটির নেতারা গোপনে থেকেই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। গণহত্যার দায় এড়াতে জোট বিলুপ্তির কথা ভাবছেন তারা। 

‘তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হলে গণহত্যার দায় আওয়ামী লীগের মতো জোট শরিকদের নিতে হবে’-মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাম্প্রতিক সময়ে যুগান্তরকে বলেন, জোটের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। এখন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ায় তারা ভোল পালটিয়েছেন। গণহত্যার সম্পৃক্ততার প্রমাণ সাপেক্ষে এ দায় কেউ এড়াতে পারেন না।

১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, এ জোটের প্রয়োজন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন কোনো কার্যক্রম নেই, জোটও নেই। কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

আওয়ামী লীগের জোট শরিকদেরও গণহত্যার দায় আছে মন্তব্য করে কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট এখন নিষ্ক্রিয়। যে কোনো মুহূর্তে বিলুপ্ত হতে পারে। আমি অসুস্থ। ৫ আগস্টের পর কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। জোট নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে এখনো জানি না। 

অপরদিকে ‘গণহত্যার দায় জোট শরিকদের ওপর বর্তায় না’-জানিয়ে জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গণহত্যার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নিয়েছে। এতে আমাদের কোনো সায় ছিল না। তাই এর দায়ভার আমাদের ওপর বর্তাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রেস রিলিজ দিয়ে স্বাগত জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ১৪ দলে নেই। কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই বন্ধ আছে। জোটটি যে কোনো মুহূর্তে বিলুপ্তি হয়ে যেতে পারে। 

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান যুগান্তরকে প্রশ্ন রেখে বলেন, ১৪ দলীয় জোট কোথায় আছে? সব জায়গায় আওয়ামী লীগ। এ জোট শুধু লোক দেখানোর। প্রয়োজনীয়তা শেষ হওয়ায় এই জোট এখন বিলুপ্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করে রশিদ খান বলেন, সম্প্রতি এক প্রোগ্রামে জোট শরিকদের দেখে তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। ১৪ দলীয় জোট অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে বলেও জানান সেই প্রতিমন্ত্রী। গণহত্যার দায় আমাদের নয়-উল্লেখ করে জোটের এই নেতা বলেন, আমরা শুধু জোট শরিক ছিলাম। ইতোমধ্যে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানিয়েছি। 

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে গণতন্ত্রী পার্টির সহ-সভাপতি নুরুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা এখন আর জোটে নেই। যারা আছে তারাও নিষ্ক্রিয়। তিনি বলেন, জোটে থেকে যারা লুটপাট, দুর্নীতি, গণহত্যা করেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত। ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র (আমির হোসেন আমু) গণতন্ত্রী পার্টিসহ বেশ কয়েকটি জোট শরিককে বিভক্ত করে দিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান নিঃশেষ করে দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন এই নেতা। 

১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা যিনি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে রয়েছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আমরা জোট শরিকরা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছি। ফোনে কয়েকটি দলের নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে। জোট ভেঙে দিতে আমরা একমত হয়েছি। বাকিদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুবিধাজনক সময়ে জোট ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তিনি বলেন, ৩ আগস্ট গণভবনে আমরা স্পষ্ট করে বলেছিলাম, ছাত্রদের ওপর গুলি চালাবেন না। যেসব মন্ত্রী হুমকি-ধমকি দিয়ে ছাত্রদের খেপিয়ে তুলেছেন, ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছেন তাদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কথা না শুনে ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছেন। আমরা ১৪ দলীয় জোট এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে পারি না। যেহেতু আওয়ামী লীগ এখন গণহত্যাকারী দল, তাই তাদের সঙ্গে আর জোট থাকতে পারে না। অনেক আগেই জোট শেষ হয়ে গেছে এখন ঘোষণার বাকি। 

২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট চারটি জাতীয় নির্বাচনে জোটের ব্যানারে নির্বাচন করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জোট শরিকদের একজন টেকনোক্র্যাটসহ চারজন নেতা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে গঠিত সরকারে জোট শরিকদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আসন বণ্টনে অনেকটাই উদাসীনতা দেখায় আওয়ামী লীগ। কোনো উপায় না পেয়ে ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে ৬ আসনে সমঝোতা হয় দলটির। কিন্তু এসব আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় জোটের মাত্র ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা একেএম রেজাউল করিম ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করেই জোট শরিক দলের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন বলেও মনে করেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের রেজাউর রশিদ খান। এ কারণেই জোটের অনেকের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষোভ আর হতাশার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাছে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ১৪ দলীয় জোট বিলুপ্তি ঘোষণার অপেক্ষা করছে শরিক দলগুলো। 

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, এখন দুঃসময় যাচ্ছে। ১৪ দলীয় জোটের কিছু দলের নেতা আছেন যারা বিপদগ্রস্ত। জোটের বড় দুই দলের শীর্ষ নেতা কারাগারে। জোট শরিকদের যেসব নেতা জোটে নেই বলে কথা বলছেন তারা পরিস্থিতির শিকার। আবার সময় এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ১৪ দলীয় জোট আছে এবং থাকবে। 

এ বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমুকে একাধিকবার ফোন করলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়, পরে খুদে বার্তা পাঠালে তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম