যুগান্তরকে সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম
শুধু নেতা নয়, নীতিরও পরিবর্তন চাই
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই বলেছেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, কেউই এই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরেনি। দুর্নীতি-দলীয়করণ-দুঃশাসন উপহার দেওয়াসহ দেশ পরিচালনায় তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নীতি ও আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা তাই শুধু নেতা নয়, নীতিরও পরিবর্তন চাই।
তিনি আরও বলেন, ধরুন-একজনের নাম ‘এ’, আরেকজনের নাম ‘বি’, আরেকজনের ‘সি’। তিনজনেরই চরিত্র একই রকম। বহু রক্তপাত আর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ‘এ’কে ক্ষমতা থেকে হটালাম, বসল ক্ষমতায় ‘বি’। সেও চুরি ডাকাতি করল, দুর্নীতি-দলীয়করণ করল, এরপর আবার আন্দোলন-সংগ্রাম করে ‘বি’কেও ক্ষমতা থেকে সরালাম। এবার ক্ষমতায় বসল ‘সি’। সেও ক্ষমতায় গিয়ে একই কাজ করল। তাহলে তো কোনো লাভ হলো না। কেন লাভ হচ্ছে না, এর কারণ হচ্ছে-আমাদের এখানে দল এবং ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নীতি-আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমন থানার একজন ওসির (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পরিবর্তন হয়। ডিসি (জেলা প্রশাসক), এসপি (পুলিশ সুপার) বদল হয়, আমলা বদল হয়; কিন্তু ঘুস-দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং অনিয়মের বদলি হয় না। এটা থেকেই যায়।
সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম প্রশ্ন রেখে বলেন, এর কারণ কি জানেন, কারণটা হচ্ছে-আমাদের মূলে গলদ। চিন্তাভাবনায় গলদ। এই গলদ দূর করতে না পারলে দেশের ভালো হবে না, দেশের মানুষেরও মঙ্গল হবে না। আর দেশ এবং দেশের মানুষের মঙ্গল না হলে দুইদিন পরপর আন্দোলন হবে। রক্তপাত ঘটবে। ছাত্র, যুবক, তরুণসহ সাধারণ মানুষ জীবন দেবে। এর মধ্য দিয়ে একদল ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হবে, আরেক দল ক্ষমতায় বসবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। অথচ সমাজের প্রতিটি স্তরেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা জরুরি।
সম্প্রতি যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম এসব কথা বলেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি আওয়ামী লীগ আমলের অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণ, দুর্নীতিবাজদের বিচারের দাবি জানানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার ভাবনার বিষয়গুলোও অকপটে তুলে ধরেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, নতুন প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্র সংস্কার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনি জোট গঠনসহ নানা বিষয় উঠে আসে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের বক্তব্যে।
শেখ হাসিনার বিদায়-পরবর্তী আগামী দিনের কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে অন্যরকম এক অবস্থা ছিল। ভয়ভীতি, দমন-পীড়নের পাশাপাশি দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের মহোৎসব চলছিল দেশে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানো। দেশে সাম্য কায়েম করা, বৈষম্য দূর করা। মানুষের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার ফল ৫ আগস্ট-পরবর্তী আজকের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের কাজ হবে মানুষের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করা।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আগের সরকার, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তারা দলীয়করণ করেনি। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত তারা দলীয়করণ করেছে। রাষ্ট্রীয় মদদে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। এরকম একটি পরিস্থিতি থেকে দেশকে উত্তরণে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শক্ত হাতে কাজ করতে হবে। এজন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। এ কাজে তারা কতটুকু সফল হতে পারবেন, তা সময় বলবে। তবে এটা ঠিক, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধনে যতটুকু সময় দরকার, আমরা তাদের ততটুকু সময় দিতে চাই।
পরিবর্তনের অর্থ কি আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপি, কিংবা আওয়ামী লীগের সময়ে যা হয়েছে, এরই পুনরাবৃত্তি-এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, আসলে দেশের মানুষ চেয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। সর্বক্ষেত্রে জনগণের অধিকারের বাস্তবায়ন। এ জনগণ সে হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলিম কিংবা অন্য কোনো ধর্মের হোক-সবার অধিকারের বাস্তবায়ন চায় দেশের মানুষ। এজন্যই তো এত আত্মত্যাগ। কত মানুষ শহিদ হয়েছেন, কত নারী বিধবা হয়েছেন, কত সন্তান এতিম হলো-এসব আমলে না নিয়ে ৫ আগস্টের পরপরই আমরা দেখলাম, লুটপাট-দখলদারি-চাঁদাবাজি। আগের সেই চরিত্রেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সুযোগসন্ধানী একটি চিহ্নিত মহল, এর সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতাকর্মী মিলে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।
সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কতদিন সময় বেঁধে দিতে চান-জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক কিছুই সংস্কার করতে হবে। মাত্র এক মাস হলো এই সরকারের। দীর্ঘ ৫৩ বছরের ঘুণে ধরা, ভেঙে পড়া, পচে-গলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে মাত্র এক মাসে কীভাবে সংস্কার সম্ভব, সম্ভব না। এজন্য তাদের যৌক্তিক সময়টুকু দিতে হবে। কিন্তু বিএনপি এখনই নির্বাচন চায়। তাদের এই চাওয়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। তারা দেশের কল্যাণের জন্য, জনগণের স্বার্থের জন্য কোনো কাজ করেছে, অতীতে আমরা তা দেখিনি। আগামী দিনে করবে, সেই সম্ভাবনাও কম। আমি মনে করি, তাদের মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে। এই যে এবারের ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল। বিএনপির বন্যার্ত মানুষের পাশে থাকাটাকেই বেশি ফোকাস দেওয়া উচিত ছিল, ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের আরও বেশি স্বোচ্চার হওয়া উচিত ছিল, ৫ আগস্টের পরপরই দলীয় পরিচয়ে যারা লুটতরাজ করছে, চাঁদাবাজি করছে, জবরদখল করছে-এসব বন্ধে তাদের নজর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা দেখিনি। আমরা দেখলাম তাদের দলের কে কোন জায়গা দখল করবে, কাকে কোথায় সিটিং করবে, ফিটিং দেবে, যেনতেন একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কত দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়া যাবে-এদিকেই মনোনিবেশ।
একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না-বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির বলেন, চোর এক বছর থাকলেও চুরি করবে। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও চুরি করবে। আর সৎ ও আদর্শবান মানুষ একশ বছর থাকলেও তিনি আদর্শভিত্তিক দেশ চালাবেন। আসলে আমাদের ভাবনায়ই গলদ রয়েছে। আমরা খারাপ লোকের মাধ্যমে দেশটাকে ভালো বানাতে চাই, এটাই সমস্যা। আজ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে যদি তাকাই, দেখা যাবে-সেখানে যারা ভিসি (উপাচার্য) কিংবা শিক্ষক রয়েছেন, তারা সবসময় অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে গেছেন। অথচ মানুষ তাদের কাছে এমনটা প্রত্যাশা করে না। সময় এসেছে, আমাদের কালোকে কালো বলতে হবে। সাদাকে সাদা বলতে হবে। রাতকে রাত, দিনকে দিন বলতে হবে। আপনার সন্তানও যদি অন্যায় করে, তাহলে বলতে হবে সে অন্যায়কারী। আর ভালো কাজ যদি আপনার দুশমনও করে, তাহলে বলতে হবে, সে আমার দুশমন হওয়া সত্ত্বেও কাজটি ভালো করেছে। আমি আসলে বোঝাতে চাইছি যে মান্দার গাছ লাগিয়ে আমাদের আমের আশা করা যাবে না। আম খেতে চাইলে আমগাছই লাগাতে হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি সম্পর্কে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, শুধু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাই নন, তার সহযোগী সব দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, লুটপাটকারী, অর্থ পাচারকারীর বিচার চাই। একই সঙ্গে যারা দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থ পাচারের কাজে সহযোগিতা করেছে বা সাহায্য করেছে, যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়; তাদেরও বিচার চাই। আমরা মনে করি, তারা সবাই একই দোষে দুষ্ট। তারাও সমান অপরাধী। তবে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটায়ও খেয়াল রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন-এমন অনেক ভালো মানুষ আছেন, যারা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত না, দুর্নীতি, লুটপাট, জুলুম, অত্যাচার করেননি, চুরি-ডাকাতি করেননি-তাদের হয়রানি যাতে না করা হয়, এটাও দেখতে হবে। অনেকের শিল্পপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো দেশের সম্পদ। দেশের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। একইভাবে অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলো আগের ফ্যাসিস্ট সরকারেরই পুনরাবৃত্তি।
অনেকেই ইসলামি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছেন, কী মনে করেন আপনি-জবাবে তিনি বলেন, এরকম দাবি যারা জানায়, তাদের বিচার হওয়া উচিত। তারা সেকুলার রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায় না, তারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন না। এমনকি কমিউনিস্ট রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায় না, তারা একটি দেশের ৯২ ভাগ মানুষ যেখানে মুসলমান, সেখানে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। এরা এই মাটি ও মানুষের লোক না। এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে না। এরা ভিন্ন এক গ্রহের লোক। এদের বিচার হওয়া উচিত।
ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনদিকে যাবে বলে মনে করেন-জবাবে তিনি বলেন, এর ফলে কিছুটা হলেও সম্পর্কে ক্ষয়িষ্ণুভাব সৃষ্টি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আগামী দিনের লক্ষ্য কী-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য কল্যাণময় রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র হবে প্রতিটি মানুষের। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আপনাদের মতাদর্শগত বিরোধ রয়েছে, এটা কি ঠিক-জবাবে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের মতাদর্শগত বিরোধ, এটা শুরু থেকেই। এখনো আছে। শুধু আমাদের সঙ্গেই নয়, আরও অনেকের সঙ্গেই তাদের আদর্শগত মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে, ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে, আকিদার প্রশ্ন আছে। এছাড়াও ওলামায়ে কেরামের মতামতের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওদুদী সাহেবের যে মতামত, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কওমি, পির-মুরিদ-এসব ইস্যুতেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নয়া জোট বা মোর্চা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে, আপনারা কি এরকম কিছু করবেন-জবাবে তিনি বলেন, আমরা জামায়াতে ইসলামীর আরও অনেক আগে থেকে এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি।