দুর্নীতির আঁতুড়ঘর অন্ধ কল্যাণ সমিতি
ভবন নির্মাণের নামেই ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ * ১ কোটি ৭১ লাখ টাকার বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন চেয়ারম্যান * সংস্থাটিকে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ তদন্ত কমিটির
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সীমাহীন দুর্নীতি-অনিয়মে নিমজ্জিত জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি (বিএনএসবি)। ৫১ বছর ধরে এখানে কার্যকলাপ চালাচ্ছে অনুমোদনহীন কমিটি। সংস্থাটি ১৯৭৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিলেও নেই কোনো অনুমোদিত গঠনতন্ত্র। সংস্থার নামে বরাদ্দকৃত ভূমিতে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে তাদের পেছনে বছরের পর বছর খরচ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
সংস্থার নামে থাকা হাসপাতালের নাম বেআইনিভাবে পরিবর্তন করে করা হয়েছে ব্যক্তির নামে। ১ কোটি ৭১ লাখ টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে ব্যবহার করছেন সংস্থার চেয়ারম্যান মিসেস ফরহাত হোসেন। অন্ধদের কল্যাণে কাজ করার কথা থাকলেও সংস্থাটি কাজ করছে কার্যনির্বাহী পরিষদের কল্যাণে।
সংস্থাটি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন সমাজসেবা অফিসার সাব্বির হোসেন। ওই প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমোদনহীন কমিটির মাধ্যমে যুগ যুগ পরিচালিত হচ্ছে সংস্থাটির কার্যক্রম, যা প্রচলিত আইন ও বিধিবহির্ভূত। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষও সংস্থাটিকে পরিবীক্ষণ ও মনিটরিংয়ের আওতায় আনেনি। বিএনএসবি পরিচালনা পরিষদে সুশাসনের অভাব আছে। তাই সংস্থাটিকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে অনতিবিলম্বে সংস্থাটিতে একজন প্রশাসক নিয়োগ অথবা অনধিক পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তত্ত্বাবধায় বডি নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ছয় মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি নিয়ে একটি তদন্ত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সেখানে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত কোনো নির্বাহী কমিটি নেই সংস্থাটির। তদন্তের অংশ হিসাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ সংক্রান্ত তালিকা চান কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে। এ সংক্রান্ত তালিকা সরবরাহ করতে ১০ দিন সময় চায় কার্যনির্বাহী পরিষদ। ওই সময় পেরিয়ে গেলেও অনুমোদিত কোনো কমিটির তালিকা দেখাতে পারেনি সংস্থার বর্তমান কর্ণধাররা। এ বিষয়ে নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, সেখানে সংরক্ষিত সংস্থার নথিতে এ ধরনের কোনো ডকুমেন্ট নেই। একই অবস্থা গঠনতন্ত্রের ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সংস্থাটির কোনো অনুমোদিত গঠনতন্ত্র পাওয়া যায়নি।
বিএনএসবির আজীবন সদস্য আইউব আলী হাওলাদার জানান, সংস্থার নামে ১৯৯৮ সালে সরকার এক একর জমি বরাদ্দ করেছিল। বরাদ্দপত্র অনুযায়ী অন্ধদের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে ওই জমিতে বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু তা না করে বিলাসবহুল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে সেখান থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্থাটির তৃতীয় তলাবিশিষ্ট একটি চক্ষু হাসপাতাল, ২০টি দোকান এবং নয়তলা ও ১২ তলাবিশিষ্ট দুটি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে।
বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়, সেখানে অস্বচ্ছতা রয়েছে। তাছাড়া যে কমিটির সঙ্গে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়, সেই কমিটি সমাজসেবা অধিদপ্তর বা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত না। তাই এ সংক্রান্ত গৃহীত সিদ্ধান্তটি আইনগতভাবে অবৈধ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সংস্থাটির নামে একটি হাসপাতাল ছিল। এর নাম বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাসপাতালটি করা হয় ব্যক্তির নামে। বতর্মানে এর নাম ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন হাসপাতাল’। এ বিষয়ে সমাজসেবা অফিসার সাব্বির হোসেন বলেন, ব্যক্তির নামে সংস্থার সম্পত্তির নামকরণের আইনগত কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি ছিল অবৈধ। অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ে তার বক্তব্য-‘কোনো সংস্থার আয়-ব্যয়ের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। কিন্তু বিএনএসবির গঠনতন্ত্র এবং অনুমোদিত কমিটি না থাকায় বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে মিসেস ফরহাত হোসেন দায়িত্ব নেন। এরপর ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা দিয়ে একটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনেন। ওই গাড়িটি তিনি নিজেই ব্যবহার করেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি তার কার্যক্রম পরিচালনায় নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কোনো তায়াক্কা করেনি। পরিচালনা পরিষদ খেয়ালখুশিমতো সংস্থা পরিচালনা করছে। এ কারণে পরিচালনা পরিষদে গ্রুপিং ও বিশৃঙ্খলা চলছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মিসেস ফরহাত হোসেন বলেন, কতিপয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাঝেমধ্যেই সংস্থার কাছে চাঁদা দাবি করেন। বহুবার চাঁদা দেওয়া হয়েছে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই তারা নানা ঝামেলা করেন। তিনি বলেন, সংস্থার সব কাজ কার্যনির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হয়েছে।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মিসেস ফরহাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলবেন আমার একজন উপদেষ্টা। আমি একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। আপনি সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নই।’