Logo
Logo
×

শেষ পাতা

এক বছরেই ব্লক বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ ভেঙে গেছে

সন্দ্বীপে বেড়িবাঁধ প্রকল্পে লোপাট ২০৫ কোটি টাকা

সেই বিশ্বাস বিল্ডার্সকে দেওয়া হলো আরও ৩২৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ * ক্ষমতাচ্যুত এমপি মিতার কমিশন বাণিজ্য ও হুমকি-ধমকিতে পালিয়ে যান বেড়িবাঁধ প্রকল্পের এক ঠিকাদার

Icon

মুজিব মাসুদ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সন্দ্বীপে বেড়িবাঁধ প্রকল্পে লোপাট ২০৫ কোটি টাকা

চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপে ২০৫ কোটি টাকার ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্পে ভয়াবহ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা ও তার পছন্দের কয়েকজন ঠিকাদারের মাধ্যমে এই লোপাটের ঘটনা ঘটে। নামকাওয়াস্তে কাজ করে প্রকল্প শেষ করার কারণে বছর যেতে না যেতে পুরো বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ব্লক ভেঙে গেছে। বাঁধেরও অসংখ্য জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেক ভাঙা অংশ দিয়ে সাগরের নোনা পানি ঢুকে যাচ্ছে দ্বীপে। 

অথচ সেই দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে ফের ৩২৫ কোটি টাকার কাজ। সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা বলেছেন, ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যে ধরনের ব্লক, বালি আর পাথর দেওয়ার কথা ছিল তার কিছুই দেওয়া হয়নি। যার কারণে বছর যেতে না যেতে ব্লকগুলো লবণ পানির স্রোতে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। 

শুধু বেড়িবাঁধ প্রকল্প নয়, অভিযোগ সাবেক এমপি মিতার কমিশন বাণিজ্যের কারণে সন্দ্বীপের শত শত উন্নয়ন প্রকল্প এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাজ না করেও বিল তুলে নিয়ে গেছে মিতার সিন্ডিকেট সদস্যরা। 
বিল না দেওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা আরিফকে পিটিয়েছে মিতার ডান হাত হিসাবে পরিচিত সাবেক মেয়র সেলিম। মিতার প্রধান ঠিকাদার হিসাবে সন্দ্বীপে দোর্দণ্ডপ্রতাপে টেন্ডার বাণিজ্য করেছে লুঙ্গি শামীম নামে এক ব্যবসায়ী। 

এভাবে ১১ বছরে মিতা ও লুঙ্গি শামীম সন্দ্বীপের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যান। লুটপাটের এই টাকার বড় অংশ পাচার হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দুবাই আর আমেরিকায়। বিনিয়োগ করা হয়েছে মিতার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয় করা হয়েছে। 

এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বন্ধু উত্তম বশাক ও হারুন রশিদ, খালাতো ভাই ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামীম খান, মাকছুদুর রহমান, সাইদুল ইসলাম, মেসবাহ উদ্দিন মিলন, কামরুজ্জামান অন্যতম। এদেরকে দিয়ে নামে-বেনামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোটি কোটি টাকার জমি প্লট, ফ্ল্যাট কিনেছেন মিতা। সন্দ্বীপের মূল শহরে স্ত্রী মাহমুদা ও সন্তানের নামে এক দাগে ৪ বিঘা হিন্দু সম্পত্তি ক্রয় করে। অথচ এমপি হিসাবে প্রথম দফায় নমিনেশন নেওয়ার সময় তার ৪৮ লাখ টাকা ঋণ ছিল।

অভিযোগ আছে যে কোম্পানিটি সন্দ্বীপের বেড়িবাঁধ সংস্কারের বেশিরভাগ কাজ করেছেন সেটি ছিল ক্ষমতাচ্যুত এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার খুবই ঘনিষ্ট। স্থানীয়দের ভাষায় বিশ্বাস বিল্ডার্ড নামে ওই কোম্পানির নেপথ্যে মালিকানার সম্পর্ক ছিল খোদ মিতা ও মিতার একাধিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির। ফলে বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাজের মান নিয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন পর্যন্ত উত্থাপন করতে পারেনি। খোদ বাঁধের মালিক কর্তৃপক্ষ সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যন্ত জিম্মি ছিল বিশ্বাস বিল্ডার্স সিন্ডিকেটের কাছে। তারা এতটাই প্রভাবশালী ছিল কাজ না করেও বিল দিতে বাধ্য করেছিল স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। এতে বাধা দেওয়ায় তৎকালীন সন্দ্বীপ সার্কেলের কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেনকে মারধর করেছিল মিতা বাহিনীর সদস্যরা। 

শুধু তাই নয় সাবেক এমপির কমিশন বাণিজ্য, হুমকি-ধমকি আর মারধরের ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে কাজ না করেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ডলি কন্সট্রাকশন নামে এক ঠিকাদার। নিয়ম মেনে ডলি কনস্ট্রাকশন কার্যাদেশ পেলেও ওই কোম্পানিকে কাজ করতে দেননি এমপি মিতা ও তার লোকজন। শেষ পর্যন্ত ওই কাজটিও বিশ্বাস বিল্ডার্সকে দিয়ে করাতে হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। 

এই ঘটনায় আরব্রিট্রেশন আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন ডলি কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, সন্দ্বীপে কাজ করতে গিয়ে তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার লোকজনকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি। মালামাল ও মেশিনপত্র নিয়ে তার জাহাজ এক মাস সন্দ্বীপ ঘাটে আটকা পড়েছিল। জাহাজ থেকে মালামাল পর্যন্ত নামাতে দেয়নি মিতা বাহিনী। বাধ্য হয়ে তার জাহাজ ফিরে আসে। 

জানা গেছে, ২০১৯ সালে সন্দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ২০৫ কোটি টাকার ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্পের কার্যাদেশ পায় ৩টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বিশ্বাস বিল্ডার্স ১২৫ কোটি টাকা, আনোয়ার ল্যান্ড মার্ক ৫০ কোটি আর ডলি কনস্ট্রাকশন পেয়েছিল ২৮ কোটি টাকার কাজ। সন্দ্বীপের মগধরার পূর্ব কর্নার থেকে সারিকাইতের সওদাগরহাট হয়ে কালিরদোনা বাংলা বাজার থেকে পশ্চিমে দুরখাল পর্যন্ত সাগর পাড়ের বেরিবাঁধ সংস্কার ও ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণের এই কাজটি পায় তিন প্রতিষ্ঠান। 

পরবর্তীতে স্থানীয় এমপির অবৈধ হস্তক্ষেপে ডলি কন্সট্রাকশন সন্দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সেটিও বিশ্বাস বিল্ডার্সকে দেওয়া হয়। এতেও খান্ত থাকেনি মিতা। ৫ আগস্ট সন্দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বিশ্বাস বিল্ডার্সকে আরও ৩২৫ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সব সেক্টরে ব্যাপক ওলট-পালট হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে এই ভূত এখনো দূর হয়নি। এই অবস্থায় এবারও সন্দ্বীপ ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্প লুটপাটের সম্ভাবনা রয়েছে। 

যুগান্তরের সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা সরেজমিন বেড়িবাঁধ ঘুরে এসে ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, বিশ্বাস বিল্ডার্স অনেক কাজ শেষ না করেই প্রকল্প ছেড়ে চলে গেছে। এতটাই নিম্নমানের ব্লক দেওয়া হয়েছে হাঁটাচলার সময় ব্লকগুলো ভেঙে গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পে দুবাই থেকে আমাদানি করা উন্নতমানের বালু ও পাথর দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা সন্দ্বীপ থেকে স্থানীয়ভাবে উত্তোলন করা বালু আর সিলেটের নিম্নমানের পাথর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করেছে। লবণ পানিতে যাতে ব্লকের কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য এক ধরনের ব্যয়বহুল কেমিক্যাল মেশানোর কথা ছিল, কিন্তু ওই কেমিক্যালও দেওয়া হয়নি। 
সংস্কার কাজে তারা ভরাট বালি আর ভূতভাঙ্গা পাথর ব্যবহার করেছে। এ কারণে এক বর্ষাতেই ব্লক ভেঙে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী কাজ শেষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ল্যাব টেস্ট করানোর কথা। কিন্তু প্রকল্পের কাজের মান এতটাই নিম্নমানের হয়েছিল মিতার অবৈধ হস্তক্ষেপে সেই টেস্ট পর্যন্ত করাতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে মিতার সঙ্গে জেলার এক নির্বাহী প্রকৌশলীর চরম ঝগড়া হয়। বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য তৎকালীন পানি সম্পদমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম সন্দ্বীপ আসেন।

জানা গেছে মিতার এই ব্লক বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে লুটপাটের সিন্ডিকেট সদস্যরা হলেন-বিশ্বাস বিল্ডার্সে স্বত্বাবাধিকারী নজরুল ইসলাম দুলাল, তার ভাই আলম, মিতার ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সদস্য সন্দ্বীপের লুঙ্গি শামীম, মগধরা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, তাৎকালীন ইউপি মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার রবিউল ইসলাম সমিরসহ বেশ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম