সংকটে রাজউকের ড্যাপ
ড্যাপ বাতিল চান আবাসন ব্যবসায়ী ও স্থপতিরা
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপ আবারও সংকটে পড়েছে। প্রভাবশালীদের চাপে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। বিদ্যমান সংকট উত্তরণে রাজউক ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে রোববার সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি সভাও করেছে।
এদিকে ২১ আগস্ট সংশোধিত ড্যাপকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি করেছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। স্থপতিরাও একই দাবিতে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তারা বলেছেন, বাতিল হলেই সমাধান, সেটা না হলেও আপাতত স্থগিত করা দরকার। তবে ২৩ আগস্ট নগর পরিকল্পনাবিদরা এক ভার্চুয়াল সংলাপে বলেছেন, বসবাস উপযোগিতার বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে। ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংস্কার করা যেতে পারে। রাজউকের বিদ্যমান দুর্বল প্রশাসন ত্রিমুখী চাপে পড়ে সবাইকে খুশি করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ছিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ড্যাপ সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে, সব পক্ষ খুশি থাকে এমন পর্যায়ে সংস্কার করা হবে। তবে বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করলে সেটা ভালো কোনো কাজ হবে না। এ বিষয়টি সব পক্ষকে বুঝতে হবে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো মাস্টারপ্ল্যানের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। তবে তা কারিগরি কমিটির মাধ্যমে সংশোধনও করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল করতে মরিয়া হয়ে লড়ছে। নতুন বাংলাদেশে এটা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, রোববার রাজউকে ড্যাপ সংশোধন সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির একটি সভা ছিল। সেখানে আবাসন ব্যবসায়ীরা দলবেঁধে গিয়েছিলেন। তারা একরকম বলপ্রয়োগ করে ড্যাপ সংশোধনের মনোভাব প্রদর্শন করেন। তাদের সঙ্গে স্থপতিরাও সুর মিলিয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
তিনি জানান, রাজধানী ঢাকা বসবাস উপযোগিতা হারিয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল করে আগের ড্যাপ এবং ইমারত নির্মাণে ফিরে গেলে, যে যার খুশিমতো ভবন নির্মাণ করবে। বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরে যাবে। রাজউকের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের একটি গ্রুপ বাসযোগ্য মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের বিরোধিতা করছে। তারা শুধু ভবন চান, শহরের বাসযোগ্যতা চান না।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। ২১ আগস্ট সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে-বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। আগামী এক বছরে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। স্বৈরশাসকের প্রণীত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে খালবিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুত গতিতে হ্রাস পাবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হবে।
তারা আরও বলেন, আবাসন এবং খাতসংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যবসা স্থবির হওয়ায় আবাসন শিল্পে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির কথা ভেবে ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) বাতিল করে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ ও মাস্টার প্ল্যান (ড্যাপ)-২০১০ বিধি অনুসারে ভবনের নকশা অনুমোদনের আদেশ দেওয়া যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্তই) সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছে। তারা দাবি জানিয়েছে-বিদ্যমান ড্যাপ বাতিল হওয়া যৌক্তিক। আইনগত জটিলতার কারণে যদি বাতিল করা না যায়, তাহলে তা স্থগিত করতে হবে। আরও বলেছে, বাস্থইসহ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া নগর পরিকল্পনাসংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আসছেন। ইতঃপূর্বে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রথম পর্যায়ে প্রস্তাবিত নগর অঞ্চলের ‘কাঠামো পরিকল্পনা’ গেজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করার পর নগরের বিভিন্ন এলাকার জন্য ‘আরবান এরিয়া প্ল্যান’ এবং পরিশেষে ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ গেজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়। ড্যাপ (২০২২-৩৫) প্রণয়নের পূর্বে ‘ঢাকা কাঠামো পরিকল্পনা’ ২০১৬ সালে প্রণয়ন করা হলেও তা গেজেটভুক্ত না করে আইনি ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে ২০২২ সালে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) গেজেট করা হয়। কাজেই এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) বেআইনি প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়েছে। এছাড়া কী প্রক্রিয়ায় বা কিসের ওপর ভিত্তি করে নগরীর ‘উন্নয়ন প্রাবল্য তীব্রতা’ ও ‘জনঘনত্ব’ নির্ধারণ করা হয়েছে তা জানতে চেয়ে বাস্থই এই পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ব্যবহৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ-উপাত্ত এবং ওয়ার্কিং পেপারগুলো জনসাধারণ এবং অংশীজনদের কাছে উন্মুক্ত করার জন্য বহুবার আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বাস্থই মনে করছে যে-এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। এজন্য তা বাতিল বা স্থগিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) গত ২৩ ভার্চুয়াল সংলাপ করে। সেখানে তারা বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবার জন্য বাসযোগ্য নগর ও জনবসতি গড়তে দরকার নগর পরিকল্পনার প্রকৃত অনুশীলন ও কার্যকর বাস্তবায়ন। অথচ ব্যবসায়িক ও গোষ্ঠীস্বার্থে আবাসন ব্যবসায়ী ড্যাপ বাতিলের মাধ্যমে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন করতে চায়, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
তারা বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের এই মহলের সঙ্গে কতিপয় পেশাজীবী ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময়ে ইমারত ও আবাসন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন, বিধিমালা, পরিকল্পনাকে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে ঢাকার বাসযোগ্যতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। সংশোধিত ড্যাপ বাতিল হলে ঢাকার বাসযোগ্যতাকে আরও বিপন্ন করে তুলবে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই মহলের ব্যবসায়িক ও গোষ্ঠী স্বার্থ যেন পরিকল্পিত ও টেকসই ঢাকা গড়ার পথে অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট নগর সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
তারা জানান, ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) ২০২২ সালের ২৩ আগস্টে অনুমোদিত হয়। পরের বছরই আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তা আবার সংশোধন করা হয়। কোনো ধরনের কারিগরি সুপারিশ ছাড়া সংশোধিত প্রজ্ঞাপনও বাতিলের দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে ড্যাপ বহাল রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বাসযোগ্য শহর গড়ার কাজ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন তারা।