বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে রাজত্ব
দোকান বাণিজ্যে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ এমপি আফজালের
মামুন আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আওয়ামী লীগের দেড় দশকে ঢাকার গুলিস্তান বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকা পকেটে ভরেছে কিশোরগঞ্জের সাবেক সংসদ-সদস্য (এমপি) আফজালচক্র। দোকান বরাদ্দ, পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধ দোকান, অবৈধ মালিকদের বৈধতা দেওয়া, চাঁদাবাজি এবং আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের সরকারি সহায়তার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এমনকি হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞায় ডিএসসিসি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে না পেরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একশ্রেণির অসাধু প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করেই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চক্রের সদস্যরা। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর গা ঢাকা দেন আফজাল ও তার ঘনিষ্ঠ নাজমুল হুদা, জহিরুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরসহ অন্যরা। ফলে ধীরে ধীরে দীর্ঘ দেড় দশকের জুলুম-নিপীড়ন নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী দোকান মালিকরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক সংসদ-সদস্য আফজাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় আত্মগোপনে আছেন। যে কারণে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। এরপর শনিবার ও রোববার দুদিন ধরে তার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হয়। ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, মহানগর হকার্স মার্কেট, আদর্শ হকার্স মার্কেট ও গুলিস্তান হকার্স মার্কেট নিয়ে ২০০৪ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স গঠিত হয়। শুরুতে এর সদস্য সংখ্যা ২৩৭০ জন থাকলেও প্রতারণার মাধ্যমে ৫৯১ জন বাড়িয়ে ২৯৬১ জন করা হয়। শুরু থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এর কার্যকরী সভাপতি ছিলেন আফজাল হোসেন, সভাপতি মো. শাজাহান মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল বাসেত। ২০০৮ সালে আফজালসহ কয়েকজন অনেককে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী উল্লেখ করে। এমন ৫৯১ জনকে অতিরিক্ত দোকান মালিক দেখিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তালিকা দেন।
২০১১-১২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নাম ভাঙিয়ে মহানগর হকার্স, গুলিস্তান হকার্স ও আদর্শ হকার্স মার্কেট থেকে ৩০টি দোকান নিজেদের কবজায় নেয় আফজাল গং। বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট থেকেও তারা হাতিয়ে নেয় ১৭৫টি দোকান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে জমা দেওয়ার মাধ্যমে ৫৯১ জন দোকান মালিকের স্বীকৃতি পান। এর মধ্যে এসব দোকান ৩০-৪০ লাখ টাকা করে অন্যের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এ ঘটনায় তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। দোকান বরাদ্দের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনেকে অভিযোগ করেন, শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিতে আফজাল সিন্ডিকেটের যোগসাজশে বঙ্গবাজারের টিন-কাঠের অস্থায়ী দোকান ভেঙে বহুতল পাকা ভবন করার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসসিসি। যেখানে দোকান বাড়িয়ে ৪ হাজারের মধ্যে ‘মেয়র কোটায় ৯৩৭টি বাড়তি দোকান’ তৈরির প্রক্রিয়াও ছিল। সাবেক সংসদ-সদস্য আফজাল হোসেন ছাড়াও জহিরুল ইসলাম, নাজমুল হুদাসহ কয়েকজন ডিএসসিসির সঙ্গে এ প্রক্রিয়া শুরু করলে ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে ব্যবসায়ী আব্দুল বাসেত, শাহ আলমসহ চারজন মিলে ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। এতে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ৬ সপ্তাহের রুল দিয়ে মার্কেট ভাঙার কারণ, ভাঙার আগে ব্যবসায়ীদের বসার বিকল্প ব্যবস্থা করা, কবে পাকা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হবে এবং নতুন দোকানে সালামি মূল্য কত হবে, তা জানতে চায় ডিএসসিসির কাছে। কিন্তু ডিএসসিসি দেড় বছরেও ওই রুলের জবাব না দিয়ে বারবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেছে। এর মধ্যে ডিএসসিসি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেট ভাঙতে ৩০০ পুলিশের নিরাপত্তা চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করে। ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের অপারেশন্স শাখা থেকে উপপুলিশ কমিশনার মো. সাহেদ আল মাসুদ ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
শাহবাগ থানা পুলিশ বঙ্গবাজার পরিদর্শনে গেলে এর দুদিন পর ১৭ জুলাই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীরা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন (নং ১৩১৬৪/১৩১৬৫)। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মার্কেট না ভাঙতে স্থিতাবস্থা জারি করেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেন, হাইকোর্টের স্থিতাবস্থা জারির ফলে অসাধু চক্রের মেয়র কোটাসহ দোকান নয়ছয়ের পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সেখানে পাইলিং কাজের জন্য ৪০ কোটি টাকার দরপত্র দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। স্থিতাবস্থার মধ্যে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল রাতে বঙ্গবাজারে রহস্যজনক আগুন লেগে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যারা অবৈধ সুবিধা করতে পারেনি, তারা আগুন দেয়-এমন অভিযোগ করে আসছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেন, আগুন নেভানোর পর নতুন করে ব্যবসা শুরুতে সহযোগীতা করতে এগিয়ে আসে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ওই সময় ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী নেতা নাজমুল হুদা ও জহিরুল ইসলামের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে একটি হিসাব খোলেন। সেখানে সাধারণ মানুষের দেওয়া কয়েক কোটি টাকা জমা রাখা হয়। ডিএসসিসি মেয়র তখন বলেছিলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রাধানমন্ত্রী ১৫ কোটি টাকা দেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা কোনো টাকা পাননি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ঢাকা ট্রেড সেন্টার (দক্ষিণ) মার্কেটের শুরু থেকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন শাজাহান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন। পরে হুমায়ুন কবীরকে সভাপতি করা হয়। ২০১৪ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের কার্যকরী সভাপতি এবং ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেন আফজাল হোসেন। ট্রেড সেন্টারে সাধারণ সম্পাদক করেন জহিরুল ইসলামকে। এ মার্কেটে ডিএসসিসির অনুমোদিত দোকান ৬৩৭টি। অন্যদিকে ঢাকা ট্রেড সেন্টার (উত্তর) মার্কেটে শুরুতে সভাপতি ছিলেন মোজাম্মেল হক মজু এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাসেত। ২০১১ সালের এপ্রিলে আব্দুল বাসেতকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে কার্যকরী সভাপতি করে নাজমুল হুদাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তবে দুই ট্রেড সেন্টারের নেপথ্য কর্তৃত্ব থেকে যায় আফজাল হোসেনের কাছে। এই মার্কেটে ডিএসসিসির অনুমোদিত দোকান সংখ্যা ৬০৮টি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, দুই মার্কেটে ১ হাজার ২৪৫টি বৈধ দোকান ছাড়াও অতিরিক্ত আরও ৭০০ অতিরিক্ত দোকান করে আফজাল গং। তারা মার্কেটে দুটি টয়লেট কমিয়ে, লিফটের জায়গা ছোট করে, জানালা কমিয়ে এসব দোকান তৈরি করে। ফলে আলো-বাতাস চলাচলে স্বল্পতা দেখা দেয় এবং অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের নাম করে দোকানপ্রতি ৭-১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দোকান মালিক সমিতি। এভাবে তারা ৬০-৬২ কোটি টাকা পকেটে ভরে। তবে দুই ট্রেড সেন্টারের ওই ৭০০ দোকান মালিকের কাছে ডিএসসিসির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এমনকি ডিএসসিসি যাতে ওইসব দোকান উচ্ছেদে উদ্যোগ না নেয়, সেজন্য দুই কোটি টাকায় মধ্যস্থতা করেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মোর্শেদ কামাল। পাশাপাশি শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিকুর রহমান ও স্থানীয় ২০নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল হান্নানও ভাগবাঁটোয়ারায় ছিলেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, দোকান মালিক সমিতির প্রভাবশালী নেতারা অর্থ লুটপাটে নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়ে গেছেন কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের চারবারের সংসদ-সদস্য অফজাল হোসেন। এ আফজাল আশির দশকে বাবার সঙ্গে গুলিস্তানের ফুটপাতে জুতা বিক্রি শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বনে যান ব্যবসায়ী নেতা ও বড় মাফিয়া। বর্তমানে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ছাড়াও দেশের বহু জায়গায় তার আফজাল সুজের শোরুম রয়েছে। নামে-বেনামে বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা।
আফজলচক্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন রিপন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ট্রেড সেন্টার মার্কেটের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পড়ও দোকান নির্মাণ করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংসদ-সদস্য আফজাল। নামে-বেনামে মার্কেটের দোকান দখল করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ ও সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করার সময় নানা বিভক্তি তৈরি করে আফজাল গং। তারা কাগুজে মালিকদের সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দিলেও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কিছুই পায়নি।
এছাড়া ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার মতো জমা হয়, যা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করে রাখা আছে। এ টাকা ক্ষতির তুলনায় খুবই কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া যায়নি। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ১৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেননি।