আশুলিয়ায় ভ্যানে লাশের স্তূপ
জার্সি দেখে স্বামীকে শনাক্ত করলেন স্ত্রী
যুগান্তর প্রতিবেদন, ঢাকা উত্তর
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি ভ্যানে একটির ওপর আরেকটি নিথর দেহ স্তূপ করে রাখার যে ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে সেটি সাভারের আশুলিয়া থানার ঠিক পাশের ঘটনা বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছে। ভিডিওটিতে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা দেহগুলোর স্তূপ থেকে ব্রাজিলের জার্সি পরিহিত একটি হাত বের হয়ে থাকতে দেখা যায়। সেই হাত দেখে ওই ব্যক্তিকে স্বামীর লাশ হিসাবে শনাক্ত করেছেন লাকী আখতার নামে এক নারী।
ওই নারী বলেন, লাশের ভ্যানে থাকা ওই ব্যক্তি তার স্বামী আবুল হোসেন। লাকীর প্রতিবেশীরাও ওই হাত আবুল হোসেন হওয়ার কথা বলেন, যিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে ব্রাজিলের জার্সি পরেই ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। লাকী ৫ আগস্ট থেকে তার স্বামী আবুল হোসেনের নিখোঁজ থাকা নিয়ে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন।
লাকী-আবুল দম্পতি থাকতেন বাইপাইল পশ্চিমপাড়ায় একটি ভাড়া বাড়ির ঘরে। তাদের দুই সন্তান। বড়টির বয়স নয় বছর, ছোটটি ছয় মাস বয়সি। আবুল দিনমজুরির ভিত্তিতে ট্রাক থেকে মালামাল নামানোর কাজ করতেন। লাকী সেখানকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তবে ছোট বাচ্চাটির জন্মের পর শারীরিক কারণে কাজ ছাড়তে বাধ্য হন। সংসারটি চলছিল পুরোপুরি আবুল হোসেনের রোজগারে। শনিবার লাকীর ভাড়া বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে। কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বারবার।
বলছিলেন, তার সন্তানদের এখন কী হবে? তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন আমার স্বামী। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছয় মাসের বাচ্চা কোলে লাকী এই কয়দিন ধরে হাসপাতাল, মর্গ, কারাগার, থানা থেকে শুরু করে সেনানিবাসে পর্যন্ত স্বামীর খোঁজে গেছেন। পরে শুক্রবার রাতে তার একজন আত্মীয়কে কেউ একজন ভিডিওটি পাঠিয়ে দেখতে বলেন। ওই আত্মীয় সেটি তাকে দেখালে তিনি স্বামীকে চিনতে পারেন। সেসময়ই ভ্যানে ঢাকা চাদর কিছুটা সরে গিয়ে আরও লাশের নিচে চাপা পড়ে থাকা একজনের হাত বের হয়ে যায়। দুই-তিন সেকেন্ডের সেই হাতের ছবি দেখে তাকে আবুল হোসেন বলে শনাক্ত করেন তার স্ত্রী, স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
লাকী বলেন, সেদিন দুপুরের দিকে ব্রাজিল ফুটবল দলের একটি হলুদ রঙের জার্সি আর লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। আশপাশে অনেকেই চেনেন আবুলকে। বাইপাইল মসজিদ থেকে যখন আসরের আজান হচ্ছিল তখনো মসজিদের পাশেই তাকে দেখেছেন স্থানীয়রা।
নিহত আবুলের প্রতিবেশীরা বলেন, ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে একটি বিজয় মিছিলে আবুলকে দেখেছিলেন তারা। ভিডিওটি দেখে স্থানীয় আলী হোসেন ধারণা করছেন, বিকালে সড়কে জমায়েত হওয়া লোকজনকে লক্ষ্য করে পুলিশ যে গুলি চালিয়েছিল তাতে অনেকেই হতাহত হন। যাদের লাশ ভ্যানে করে সরিয়ে ফেলা হয়।
তবে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। ভ্যানের লাশগুলো কোথায় গেল সেটিও জানে না পুলিশ। ভ্যানের লাশগুলোই কি লেগুনায় তোলা হয়েছিল কি না সে তথ্যও নেই তাদের কাছে। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুইদ কয়েকদিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। মোবাইলে লাকীর বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনলাম। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি, তবে এখনো বিস্তারিত কিছুই জানি না।
তদন্ত কমিটি গঠন, ঘাতক চিহ্নিত : আশুলিয়া প্রতিনিধি জানান, ভ্যানে লাশের স্তূপের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অ্যাডিশনাল এসপি ও ডিএসবি কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ঘাতকদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। রোববার আশুলিয়া থানা পরিদর্শন শেষে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ।
তিনি বলেন, ভিডিওটি আমাদের নজরে এসেছে। আমাদের জায়গা থেকে যা করণীয় তা আমরা করছি। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন। আমরা জানতে পেরেছি কারা এ ঘটনায় জড়িত, কারা উপস্থিত ছিলেন। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য নামগুলো প্রকাশ করছি না। অপরাধী সে যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। পুলিশ আইনের বাইরে নয়।