পাচারের অর্থ উদ্ধার
কৌশলপত্র বাস্তবায়নের নির্দেশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংস্থাকে
পৃথক লিগ্যাল উইং, অথরিটি সার্ভিস, উপদেষ্টা বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের প্রণীত ‘কৌশলপত্র’ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে। ওই কৌশলপত্রে বিদেশে পাচারের অর্থ বা সম্পত্তি চিহ্নিত করার পর জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করার কথা রয়েছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তদন্ত করা যাবে। এছাড়া মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পৃথক লিগ্যাল ইউং প্রতিষ্ঠা করবে-এমন নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব নির্দেশ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এর আগে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ‘জাতীয় সমন্বয়’ কমিটির বৈঠক হয় অর্থ বিভাগে। সেখানে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে।
এ প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা প্রথমে চাই দেশে কালোটাকা সৃষ্টি বন্ধ করতে। এছাড়া দুই বছর আগে বেশকিছু সিদ্ধান্ত ছিল অর্থ পাচার প্রতিরোধে, যা বাস্তবায়ন হয়নি। অনেকদিন ধরে এসব সিদ্ধান্ত পড়ে আছে। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুর্নীতি, ব্যাংকের ঋণখেলাপি ও বিদেশে অর্থ পাচার একই সূত্রে গাঁথা এবং একই চক্র এ কাজ করছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপির মধ্যে ৮ প্রতিষ্ঠানই অর্থ পাচারে জড়িত। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। জিএফআই তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ সালের বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪৯.৬৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।
অর্থ পাচারের অভিযোগে অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হলেও স্বাধীনতার পর পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজির আছে মাত্র দুটি। এর বাইরে পাচার অর্থ উদ্ধারে সরকারের তেমন কোনো সফলতা নেই।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ৭.৫ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকারীরা অর্থসম্পদ দেশে ফেরত আনতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সুবিধার আওতায় একজনও অর্থ ফেরত আনেননি। এর মূল কারণ ছিল পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে যে টুলস বা সিদ্ধান্ত ছিল, সেগুলো বিগত সরকার বাস্তবায়ন করেনি।
অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং পাচারের অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত একাধিক সমন্বয় কমিটির বৈঠকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে চারটি সিদ্ধান্ত হয়। এসব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাচারের অর্থ ফেরাতে সরকার একটি ‘কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করে এটি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া দুদক ছাড়া মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ‘পৃথক লিগ্যাল উইং’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও জানা যায়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে ‘পৃথক অথরিটি সার্ভিস বা ইনডিপেনডেন্ট প্রসিকিউশন সার্ভিস’ চালুর কথা ছিল। পাশাপাশি সজাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে অপরাধ সম্পর্কিত পারস্পরিক সহায়তার জন্য ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় কেন্ত্রীয় ব্যাংককে সহায়তার লক্ষ্যে ‘উপদেষ্টা বোর্ড’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বড় চারটি সিদ্ধান্তের মধ্যে একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউ-এর নজরধারীর ব্যর্থতা ছিল। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নজরধারীর অভাব ছিল। এ সুযোগ নিয়ে খেলাপিরা ব্যাংক ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এ সুযোগ আসছে নতুনভাবে এসব সংস্থার আইন ও বিধি সংস্কার ও পাচারের অর্থ উদ্ধারে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ। এটি করা গেলে আগামী দিনের জন্য এ বার্তা বহাল থাকবে।
জানা যায়, সরকারের ছয়টি সংস্থা মিলে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে। সেখানে বলা হয়েছে, যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সে দেশের সর্বোচ্চ সহযোগিতা না পেলে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি, স্টার প্রটেকশন এজেন্সি ও ইউনাইটেড নেশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের সহযোগিতা নেবে সরকার। এছাড়া সুইজারল্যান্ডসহ যেসব দেশ থেকে অনানুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত, সেসব দেশের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আইনগত সহায়তার অনুরোধকে অগ্রাধিকার দেবে সরকার। যেসব ক্ষেত্রে পাচারকারী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কৌশল বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে, তা কৌশলপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া আসামি পলাতক হলে এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ গঠন সম্ভব না হলে কিংবা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তি মারা গেলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তি এতই ক্ষমতাশালী যে, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ গঠন বাস্তবসম্মত নয়; যেখানে তৃতীয় পক্ষের কাছে সম্পদ রয়েছে এবং তিনি ওই সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে শুনানিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী নন এবং যেখানে ফৌজদারি আদালতে অপরাধ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়-এসব ক্ষেত্রেও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয় ওই কৌশলপত্রে।
এছাড়া বিদেশে পাচার করা অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতার কথাও কৌশলপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন: বৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করলে বাংলাদেশের আইনে তা অপরাধ হলেও অনেক দেশের আইনে তা অপরাধ নয়। তাছাড়া কোনো কোনো দেশ অর্থ বা সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার সময় তার অংশবিশেষ দুর্নীতি দমন বা অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার শর্তারোপ করে থাকে।