বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
আড়াই হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে ব্র্যাক ব্যাংক
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক গত চার বছরে আড়াই হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছে। অধিকাংশ কর্মকর্তাকে নানা কারণে জোরপূর্বক ছাঁটাই করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে দেড় হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিন বছরের বেশি সময় একই শাখায় ও বিভাগে বহাল রেখেছে। আবার একই বিভাগে চার থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বহাল রাখারও নজির রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্র্যাক ব্যাংক ২০২১, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পর্যায়ক্রমে ৭২০ জন, ৯৯৮ জন, ৮৩৫ জন ও ১১৫ জনকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছে। চার বছরে সব মিলিয়ে দুই হাজার ৬৬৮ জনকে ছাঁটাই করে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক বাদ দেওয়া হয়। যদিও ব্যাংকটি বলছে, কাউকে জোরপূর্বক বাদ দেওয়া হয়নি। যেসব কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, টানা চার বছর ধরে সর্বোচ্চ পারফর্মার হওয়ার পরও শুধু এক বছর নন-পারফর্মার হিসাবে মূল্যায়ন করে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। পারফরমেন্স মূল্যায়ন ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিভাগভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, যার কোনোটিই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে অনুমোদিত নয়। এছাড়া ব্যাংকটির সব স্থায়ী কর্মকর্তা একক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়িত হয় না। আবার বিভিন্ন বিভাগের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রধানের পছন্দ বা অপছন্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাছাড়া ব্যাংকটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পাশপাশি বিভাগ ভিত্তিক আলাদা মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকায় বিভাগ প্রধানের আলাদা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা ব্যাংকটির সার্বিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে বিশৃঙ্খল এবং অকার্যকর করে তুলছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নন-পাররফমার হিসাবে মূল্যায়িতদের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে টার্মিনেট করার হুমকি দেওয়া হয়। ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত পরিসংখ্যানও এই অভিযোগ প্রমাণ হয়। টার্মিনেট হলে অন্য কোথাও চাকরি হবে না, এই ভয়ে অনেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সাল এই তিন বছরে দুই হাজার ৫৫৩ জনকে ব্যাংক সেপারেশন করে। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখায় ৯৫ শতাংশ। টার্মিনেশন ৩ শতাংশ এবং ডিসমিসাল ২ শতাংশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোথাও একটি প্রতিষ্ঠানের ৯৫ শতাংশ কর্মকর্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন। ব্যাংকটির অধিকাংশ কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত করেছে। যারা চাকরি ছাড়তে চায়নি তাদের টার্মিনেশনের ভয় দেখানো হয়েছে। অনেকে অন্য কোথাও চাকরি পাবে না ভয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নথি বিশ্লেষণে দেখতে পায়, টার্মিনেট হওয়া কর্মকর্তা এবিএম সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত প্রতিবেদনে কাশপিয়া আশফাক নামক একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। যদিও তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে কাশপিয়ার নিয়োগের কোনো অনুমোদন নেই। কেবল হেড অব ইনভেস্টিগেশন বিভাগের মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামের মৌখিভাবে তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়োজিত করেন। মাত্র একজন কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাকে টার্মিনেট করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।
এক্ষেত্রে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা স্পষ্ট প্রমাণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
চাকিরচ্যুত এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। একটি শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার বলেন, স্বেচ্ছায় কেউ চাকরি ছাড়ে না। সবাইকে জোরপূর্বক বাদ দেওয়া হয়েছে। আর স্বেচ্ছায় কেনো চাকরি ছাড়তে যাব।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন ইকরাম কবির যুগান্তরকে বলেন, গত পাঁচ বছরে সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি চলে গেছে। এই পাঁচ বছরে সাড়ে চার হাজার ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুভাবে ব্র্যাক ব্যাংক ছাঁটাই করেছে। প্রথমত. পারফরম্যান্সের কারণে ২৩৯ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এরা বেশিরভাগই রিটেইল ও এসএমইর। এদের টার্গেট দেওয়া হয়। ৬ মাস ধরে দেখা হয়। ছয় মাসে টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরপর টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ছাঁটাই করা হয়। দ্বিতীয়ত. ২২২ জনকে শৃঙ্খলাপরিপন্থি কার্যকলাপের জন্য ছাঁটাই করা হয়। এসব বাংলাদেশ ব্যাংকেও আমরা জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য দিয়েছে, তার সঙ্গে একমত নই। আমাদের ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া পুরো ডকুমেন্টেড। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে আসলে কিছু নেই।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-১৫ এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এক হাজার ৫৪৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে একই শাখা/বিভাগে দীর্ঘদিন বহাল রেখেছে ব্যাংকটি। আবার একই বিভাগে চার থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বহাল রাখারও নজির রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তদন্ত প্রতিনিধি দলকে বলা হয়, ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সব কাজ বিশেষায়িত এবং বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের দ্বারা করা হয়। যদিও নিয়োগের সময় তাদের বিশেষায়িত এবং বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি ব্যাংকটি।