Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৫৯

ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

দেশের এগারো জেলায় বন্যায় কৃষক, মৎস্যচাষি ও খামারি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি ও বসবাসের নানা সরঞ্জাম তছনছ হয়ে গেছে। নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে ভিটেমাটি। ভেসে গেছে ফসলের মাঠ, পুকুর, মাছের ঘের এবং হাস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার। কেউ কেউ বাড়িঘর ও অর্থনৈতিক অবলম্বন হারিয়ে পথে বসেছেন। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধিই আত্মগোপনে। ফলে ভয়াবহ বন্যায় জনপ্রতিনিধিদের পাশে পায়নি তারা। তবে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। সহায়-সম্বল হারা লোকজন বলছেন, এখন ত্রাণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহায়তাও প্রয়োজন তাদের, তা নাহলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।

শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে জানা গেছে, চলমান বন্যায় মৃত্যুর সংখ্যা একদিনে আরও পাঁচজন বেড়েছে। এ নিয়ে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫৯ জনে। এর মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ৬ জন ও শিশু ১২ জন। এদের মধ্যে কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ২৩, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে এক, নোয়াখালীতে ৯, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন, কক্সবাজারে ৩ জন ও মৌলভীবাজারে একজন মারা গেছেন। এছাড়া মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে মোট ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শুক্রবার লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুমিল্লা, ব্রাহ্মণপাড়া ও লাকসাম-মনোহরগঞ্জ : বন্যায় জেলার ১৪ উপজেলার ৪ লক্ষাধিক কৃষক তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। কোনো প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই এমন প্লাবনে হতবাক এসব কৃষক। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ফসলি জমি এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে। ৬৩ হাজার ৭৯৪ হেক্টর ফসলি জমি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। জেলায় ৭৫৫ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রোপা আমন বীজতলা ৩ হাজার ১৭৮ হেক্টর ও ধান ২২ হাজার ৯২ হেক্টর, খরিপ-২ শাকসবজি ১ হাজার ৪১৩ হেক্টর, আউশ ২২ হাজার ৯৩ হেক্টর, বোনা আমন ৫৫৪ হেক্টর এবং ৭৭ হেক্টর আখের ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আইয়ুব মাহমুদ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ক্ষতির একটা খসড়া তৈরি করেছি। এ পর্যন্ত ৭৫৫ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে বলে জানান তিনি।

নাঙ্গলকোট উপজেলা মৎস্য অফিসার ইসরাত জাহান বলেন, বন্যায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। উপজেলায় ৩ হাজার ৩৯৩ জন মৎস্য চাষি রয়েছেন। সবার তথ্য পেলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহিদা আক্তার বলেন, এখনো সরকারিভাবে কোনো পুনর্বাসনের বরাদ্দ আসেনি। পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মনোহরগঞ্জ উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বন্যাক্রান্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের লক্ষ্যে উপজেলার তিনটি হাব সেন্টার খোলা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় হাব সেন্টারগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা কাজ করছেন।

লক্ষ্মীপুর, রায়পুর ও রামগতি : বন্যার কারণে অবকাঠামো ও খাদ্য বিনষ্টসহ খামারি-গৃহস্থদের পশুপাখি মারা গিয়ে ৮ কোটি ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো ৫ লাখ ১১ হাজার ১১০টি পশু-পাখি বন্যা কবলিত রয়েছে। এতে খামারিসহ গৃহস্থরা বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন স্থানে খামার ও গৃহস্থের ১ লাখ ৬০ হাজার ২১৩টি পশুপাখি মারা গেছে। এরমধ্যে ৩৫টি গরু, ১৭৫টি ছাগল, ১৭টি ভেড়া ও ১টি মহিষ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০টি মুরগি ও ৯৭৫টি হাঁস মারা গেছে। এতে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশুসহ ৩০৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা, হাঁস-মুরগিসহ ৪২৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এছাড়া ১ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকার পশুপাখির খাদ্য বিনষ্ট হয়েছে বন্যায়।

রামগতির চর পোড়াগাছা, চর বাদাম ইউনিয়ন ও কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা ইউনিয়নের বন্যা কবলিত বেশিরভাগ লোক এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কমলনগরে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে আছেন অনেকে।

শনিবার দুপুর ৩টায় জেলা সিভিল সার্জন আহাম্মদ কবীর জানিয়েছেন, ১২ দিনে বিভিন্ন স্থানে ১১২ জনকে সাপে কামড় দিয়েছে। সদর হাসপাতালে ৮০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

সোনাগাজী ও দাগনভূঞা (ফেনী) : ছোট ফেনী নদী ওপর নির্মিত সাহেবের ঘাট সেতুর পশ্চিম অংশের সংযোগ সড়কে বন্যার পানির চাপে ভেঙে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কটিতে শুক্রবার বিকাল থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। গর্তটি দেখতে সেতু এলাকায় ভিড় করেছেন হাজারো মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পানির চাপে সেতুর নিচ থেকে দুই পাশের মাটি ও ব্লক সরে গেছে। এরপর সংযোগ সড়কেও ভাঙন দেখা দিতে শুরু করে। এ অবস্থায় স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বালুভর্তি বস্তা দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করেন। এর আগে ২৬ আগস্ট সকালে বন্যার পানির চাপে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ২৩ গেট বিশিষ্ট মুছাপুর রেগুলেটর (স্লুইসগেট) নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এটি পুনর্র্নির্মাণ এবং সাহেবের ঘাট সেতুর সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার বিকালে সোনাগাজী ও কোম্পানীগঞ্জে কয়েকশ মানুষ সেতু এলাকায় মানববন্ধন করেন। এদিকে দাগনভূঞা কৃষি অফিস জানায়, বন্যায় উপজেলার ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন, ৫৬০ হেক্টর জমিতে সবজি, ৫ হাজার ৬৬৩টি পুকুরের মাছ, ৯৩টি দিঘি ও ৩২২টি মাছের ঘের ভেসে গেছে।

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) : বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজনের তিনবেলা খাবার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যারা নিজ বসতভিটায় আটকা পড়েছেন তারা বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের জন্য কষ্ট করছেন। সরেজমিন কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন সড়কে ত্রাণের গাড়ি দেখলে ছুটে যাচ্ছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। হাত বাড়িয়ে ত্রাণ চাওয়ার পাশাপাশি অনেক নারী-পুরুষকে দেখা গেছে ত্রাণের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যেতেও।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম