বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, চিকিৎসায় জটিলতা
ব্যয়বহুল পরীক্ষা বাইরে ওষুধ মিলছে বিনামূল্যে
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের সব ধরনের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সব সেবা মিলছে না। বিশেষ করে ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে।
এর কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ হাসপাতালে সিটি স্ক্যান ও এমআরআই মেশিনের মতো দামি যন্ত্রপাতিগুলো দীর্ঘদিন থেকে অকেজো থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে যারা দরিদ্র পরিবারের তাদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
অনেকে ইতোমধ্যে দায়দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। সরেজমিন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে বেশ কয়েকজন রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের একটি বিছানায় নিশ্চুপভাবে বসে থাকতে দেখা যায় ১৮ বছরের যুবক মাকসুদুর রহমান মুন্নাকে। এই প্রতিবেদক গণমাধ্যমকর্মী এমন পরিচয় দেওয়ার পর তিনি জানান রাজধানীর বংশালে ভাইয়ের সঙ্গে থেকে কোচিং করতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর শুনে বিকালে বিজয় মিছিলে গিয়েছিলেন।
হঠাৎ পুলিশের একটি বুলেট লেগে তার পিঠের বাম পাশের মেরুদণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে যায়। কয়েকজন মিলে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে এখানে রেফার্ড করা হয়। সিটি স্ক্যান ও এক্সরে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা জানান, শরীরে বিদ্ধ গুলি তিন টুকরা হয়ে ভেতরে রয়ে গেছে। ক্ষতস্থানে ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে।
কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বুলেট বের করা সম্ভব নয়। দূষিত রক্ত ও ময়লা বের করার জন্য টিউব পরিয়ে দেওয়া হয়। ২১ আগস্ট টিউব খুলে দেয়। এরপর ২৪ আগস্ট অপারেশন করে বুলেটের একটি টুকরো বের করেছে। আরও দুটি টুকরা শরীরে রয়ে গেছে। এখানে প্রয়োজনীয় মেশিন না থাকায় পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
মাকসুদুর রহমান মুন্নার মা রোজিনা ইয়াসমিন আক্ষেপ করে বলেন, ছেলে আহত হওয়ার পর বেশ কয়েক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে এক্সরে, ইসিজি ও কিছু সহজ পরীক্ষা ছাড়া সিটি স্ক্যান, ইকো কার্ডিওগ্রামের মতো ব্যয়বহুল পরীক্ষাগুলো বাইরে করাতে হচ্ছে।
এদিকে রাত হলেই সেলাইয়ের স্থানে ব্যথা বাড়ে, হাঁচি-কাশি দিলেও কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য আহত হয়েছে। গত ১ মাস ধরে হাসপাতালের বারান্দায় মাদুর পেতে সুস্থতার অপেক্ষা করছি। শুনেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছেন, আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এখানে বেশকিছু রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও তেমন কেউ খোঁজ নিতে আসেননি।
রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিটের (আরসিইউ) এক নম্বর বিছনায় অক্সিজেন মাস্কের সাহায্যে শ্বাস নিচ্ছিলেন ২৬ বছর বয়সি যুবক আসগর ফকির। বৃদ্ধা মা আজিমুনেচ্ছা ছেলের কাঁধে হাত রেখে অপলক ভঙ্গিতে চেয়েছিলেন। অক্সিজেন নেওয়া শেষ হলে এই প্রতিবেদককে আসগর ফকির বলেন, তিনি কখনোই আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না।
৫ আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে শুনে সহকর্মীদের সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছিলেন। তখনও পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায় স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা একজোট হয়ে ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া দিচ্ছিল। একপর্যায়ে পুলিশ মুহুর্মুহুভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। আকস্মিক একটি বুলেট এসে তার বুকের ডানপাশ ভেদ করে পিঠের পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়।
ছাত্র ও সহকর্মীরা দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে গেলে চিকিৎসকরা ব্যান্ডেজ বেঁধে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রেফার্ড করে দেন। এখানে আসার পর চিকিৎসকরা জানান, বুকের ভেতরে ময়লা জমেছে। অপারেশন করে বের করতে হবে। চিকিৎসকরা সোমবার অপারেশনের তারিখ দিয়েছেন।
আজিমুন্নেসা এই প্রতিবেদককে বলেন, তার স্বামী মারা গেছেন দীর্ঘ বছর হলো। বসবাসের জন্য বাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোনো জমিজমা নেই। পেটের দায়ে আসগরকে ১০ বছর বয়সে ঢাকার সদরঘাটের তেলঘাটে দর্জির কাজ শিখতে পাঠান। ছেলেই সংসারের হাল ধরেছিল। কিন্তু পুলিশের গুলিতে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
আজিমুন্নেসা আরও বলেন, দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলে ৭০ হাজার টাকার মতো চলে গেছে। সরকারি ঘোষণার পর গত ১ সপ্তাহ হলো বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন। তারপরও ফলমূল কেনাসহ প্রতিদিনই খরচ হচ্ছে। সাহায্য বলতে হাসপাতালের সমাজ কল্যাণ থেকে ৫ হাজার এবং ১৯৯৮ সালের এসএসসি ব্যাচের ব্যানারে কয়েকজন ছাত্র ৫ হাজার এবং আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সহায়তা পেয়েছেন।
আরসিইউর দুই নম্বর বিছানায় চিকিৎসাধীন নিচ্ছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার তাহেরপুর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সাব্বির হোসেন। বিছানার পাশের সেলফে রাখা সিটি স্ক্যানসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্রগুলোর বেশিরভাগই বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করানো। তিনি জানান, বাবা অন্যের জমি চাষাবাদ করে সংসার চালান।
আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মাঝে মাঝে বরিশাল সিটি করপোরেশনে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে ড্রেন নির্মাণের কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতাম। আন্দোলনের শুরু থেকেই জড়িত ছিলাম। ৫ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে বরিশাল চৌমাথা এলাকায় আমাদের (ছাত্র-জনতা) সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এ সময় তার বুকের ডানপাশে বুলেট লেগে পেছনের মেরুদণ্ডের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। প্রথমে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে নিয়ে ২ দিন আইসিইউতে এবং ৩ দিন ওয়ার্ডে ভর্তি রেখে রিলিজ দেয়।
১০ দিন পর ফলোআপে চিকিৎসা নিতে এলে এক্সরে করে চিকিৎসকরা জানান, ফুসফুসে পানি ও রক্ত জমে গেছে। অপারেশন করে বের করতে হবে। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি দেখে ২০ আগস্ট এই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এখানের চিকিৎসকরা জানান, ফুসফুসে রক্ত ও ময়লা পানি জমে আছে। এখানে আসার আগ পর্যন্ত ওষুধপথ্য কিনতে হয়েছে। ছাত্র ও স্বজনরা খরচ দিয়েছেন। বর্তমানে ফ্রি ওষুধ পাচ্ছি। তবে যেসব পরীক্ষা হাসপাতালে নেই সেগুলো বাইরে করাতে হচ্ছে।