Logo
Logo
×

শেষ পাতা

নারকোটিক্সে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি

দেশকে মাদকমুক্ত করতে ১০ দফার আলটিমেটাম

কঠোর শাস্তি দিতে হবে দুর্নীতিবাজদের * অনেকে ভোল পালটে এখন বিএনপি সাজছে

Icon

তোহুর আহমদ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশকে মাদকমুক্ত করতে ১০ দফার আলটিমেটাম

রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে দেশ থেকে মাদকের অভিশাপ দূর করতে একগুচ্ছ দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (নারকোটিক্স) প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ১০ দফা লিখিত দাবি তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দল মহাপরিচালকের সঙ্গে বিদ্যমান উদ্বেগজনক মাদক পরিস্থিতি ও প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা করেন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের মূল দাবি পাশ কাটিয়ে নিজেদের আওয়ামীবিরোধী পরিচয়ে সুবিধা নিতে মরিয়া একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা- কর্মচারী। ইতোমধ্যে তাদের একটি অংশ অবিলম্বে প্রাইজ পোস্টিং পাইয়ে দিতে দেনদরবার শুরু করেছেন। এমনকি ঘুসের অবারিত সুযোগ রয়েছে এমন জায়গায় পোস্টিং দিতে বিএনপি নেতাদের দিয়ে দফায় দফায় ফোন করাচ্ছেন কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব অনৈতিক তদবির কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি জানিয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। আমরা তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি দেশ থেকে মাদকের অভিশাপ দূর করতে আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা প্রয়োগ করব। এ জন্য ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি।

অধিদপ্তরের সুবিধাবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা সম্পর্কে প্রশ্ন কর হলে তিনি বলেন, আমি এখানে মাত্র তিন মাস হলো এসেছি। এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেকের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যারা দুর্নীতিবাজ এবং ঘুষের সুযোগ নিতে প্রাইজ পোস্টিংয়ের তদবির করছেন তাদের হয়তো শেষ পর্যন্ত দুদকের মুখোমুখি হতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৮ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দল নারকোটিক্সে হাজির হন। এ সময় ৪০ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও পান্থপথ এলাকার সমন্বয়ক মোহাম্মদ তানভীর। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ১৬ জন মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় দেশ থেকে মাদক নির্মূলে অধিদপ্তরের কার্যক্রম আরও জোরদারের দাবি জানান তারা। এছাড়া তাদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানানো হয়।

উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেন, যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করতে হবে। এছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিতদের ছাড় দেওয়া যাবে না। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানতে চাইলে শনিবার বিকালে মোহাম্মদ তানভীর যুগান্তরকে বলেন, আমরা যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে মাদক নির্মূল দেখতে চাই। প্রাথমিকভাবে আমরা বেশকিছু দাবি দাওয়ার কথা জানিয়েছি। তবে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে আমরা বিপদগ্রস্ত মানুষদের বাঁচাতে দুর্গত এলাকায় যাচ্ছি। আমরা পরে হয়তো এ বিষয়গুলো নিয়ে ফের আলোচনায় বসব।

১০ দফা : শিক্ষার্থীদের লিখিত ১০ দফার মধ্যে রয়েছে, মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার এবং বিপণন বন্ধে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কার্যক্ষমতা-দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদক পাচারের প্রবণতা কমানোর জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি, নজরদারি বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রচারাভিযান এবং শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

মাদকাসক্তদের জন্য পর্যাপ্ত পুনর্বাসনকেন্দ্র এবং মানসম্মত চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।

এছাড়া পুনর্বাসিত মাদকাসক্তদের পুনরায় সমাজে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাদক থেকে দূরে রাখতে স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে মাদকবিরোধী শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে প্রাধান্য দিতে হবে। মাদক সমস্যা সমাধানে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, তাই পিতা-মাতাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে প্রাধান্য দিতে হবে।

মাদক সমস্যার প্রকৃত অবস্থা, কারণ এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে গবেষণা করে ফলাফল সরকারের কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। সর্বোপরি মাদক নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন।

নারকোটিক্স বলছে, শিক্ষার্থীদের এসব দাবি নতুন নয়। এমনকি বেশির ভাগ দাবি অধিদপ্তরের নিজস্ব লক্ষ্য পূরণের জন্য বাস্তবায়নাধীন। তবে বিভিন্ন স্তরে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম এবং দুর্নীতি জেঁকে বসায় মাদক নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ এতদিন সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। এমনকি একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মাদক নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকলেও নানা কারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে অধিদপ্তরের একটি বড় অংশ নানা ধরনের অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত। এর মধ্যে বার লাইসেন্স বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। এছাড়া অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা আদায় অনেকটা ওপেন সিক্রেট।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র আন্দোলনের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো নারকোটিক্সেও একশ্রেণির সুবিধাবাদী দাবি দাওয়া আদায়ের নামে সোচ্চার। চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোল পালটে এখন নিজেদের বিএনপিঘনিষ্ঠ বলে জাহির করছেন। এমনকি বিএনপি নেতাদের দিয়ে দফায় দফায় ফোন করাচ্ছেন তারা। বেশির ভাগই পোস্টিং চান ঘুসের হাট হিসাবে পরিচিত রমনা, গুলশান, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, উত্তরা, খিলগাঁও, মতিঝিল ও তেজগাঁওর মতো সার্কেলে।

এছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট অঞ্চলের বেশকিছু ঘুসপ্রবণ সার্কেলে পোস্টিং পেতেও মরিয়া হয়ে তদবির করছেন কেউ কেউ। এদের মধ্যে কেউ কেউ বঞ্চিত পরিচয়ে প্রাইজ পোস্টিং পেতে মরিয়া। তবে যেসব কর্মকর্তা ঘুস বাণিজ্যের সুযোগ পেতে প্রাইজ পোস্টিংয়ের তদবির করছেন গোপনে তাদের তালিকা তৈরি করে দুদকের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নারকোটিক্স। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয়ে বেপরোয়া আচরণ এবং দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, স্বৈরাচার হটিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে তখন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সুবিধাবাদী আচরণ সত্যি হতাশাজনক। মূলত তাদের অনৈতিক তদবিরের চাপে অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কাজকর্ম অনেকটাই বাধগ্রস্ত হচ্ছে। বিশৃঙ্খল পরিবেশে অনেকের মধ্যে চেপে বসেছে প্রাইজ পোস্টিং হারানোর ভয়। এ অবস্থায় ব্যাহত হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম