Logo
Logo
×

শেষ পাতা

এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ ৩ মাস

সামিটের ক্যাপাসিটি চার্জ দাবি ২৭০ কোটি টাকা

বিশেষ ক্ষমতা আইনে টেন্ডার ও যাচাই-বাছাই ছাড়া কাজ দেওয়া হয় সামিটকে

Icon

মুজিব মাসুদ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সামিটের ক্যাপাসিটি চার্জ দাবি ২৭০ কোটি টাকা

কক্সবাজারে সামিট গ্রুপের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। এফএসআরইউটি গত ৩ মাস ধরে বন্ধ। এ বন্ধ সময়ের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সামিট গ্রুপ ২৭০ কোটি টাকা দাবি করেছে জ্বালানি বিভাগের কাছে।

তাদের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী টার্মিনাল বন্ধ থাকলেও তাদের মাসে ৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কথা। ৩ মাস ধরে বন্ধ থাকায় ২৭০ কোটি টাকা চার্জ ধরা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় গ্যাস সংকটে দেশের শিল্প-কলকারখানাগুলো ধ্বংস হওয়ার পথে। এরপরও তারা ২৭০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দাবি করছে। তারা বলেন অবিলম্বে এ ধরনের দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করা উচিত।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে টেন্ডার ও যাচাই-বাছাই ছাড়া দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে সামিট গ্রুপকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিধান বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইনের আওতায় এই কোম্পানিটিকে পরপর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। দুটি টার্মিনালের ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। চুক্তি হলেও দ্বিতীয় টার্মিনালটির এখনো নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।

২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল চালু প্রথম টার্মিনালটি গত প্রায় ৩ মাস ধরে অচলাবস্থায় কক্সবাজারসংলগ্ন গভীর সাগরে পড়ে আছে। এদিকে এফএসআরইউ অচল হয়ে পড়ে থাকলেও সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সামিটের। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ চুক্তিতে বলা আছে, এফএসআরইউ অচল বা বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে সামিটকে ৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। দেশবিরোধী এই চুক্তির খেসারত হিসাবে জ্বালানি বিভাগের কাছে সম্প্রতি ২৭০ কোটি টাকা বিল দাবি করেছে গ্রুপটি। ইতোমধ্যে এ বিল আদায়ে তারা জ্বালানি বিভাগকে বেশ কয়েকবার হুমকি-ধমকিও দিয়েছে। বলেছে, ক্যাপাসিটি চার্জ বা চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিল না দিলে তারা টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না। এতে বেকায়দায় পড়েছে সরকার।

তবে জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এফএসআরইউটি এভাবে অচল থাকার পেছনে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে থাকতে পারে। এভাবে কৃত্রিম গ্যাস সংকট তৈরি করে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য সামিট গ্রুপ কোনো ষড়যন্ত্র করছে কিনা তা তদন্ত করে দেখার দাবি জানান তারা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরকম একের পর এক দেশবিরোধী চুক্তি করে পুরো জ্বালানি বিভাগকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সিন্ডিকেট এভাবে একের পর এক চুক্তি করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বিনিময়ে শত শত কোটি টাকা আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং করেছে বলে অভিযোগ আছে।

দেশে বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রক্রিয়াকরণ ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে দুটি। এর মধ্যে সামিটের টার্মিনালটি প্রায় ৩ মাস ধরে বন্ধ। ফলে দৈনিক প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে, বেড়েছে ভোগান্তি। এ অবস্থায় টার্মিনাল কবে চালু হবে, তা ১ দিনের মধ্যে জানাতে সামিটকে চিঠি দিয়েছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি (আরপিজিসিএল)।

২৬ মে ঘূর্ণিঝড়ে ভাসমান টার্মিনালটি (এফএসআরইউ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর একাধিকবার চালুর তারিখ ঘোষণা করা হলেও এখনও তা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সামিট বিবৃতিতে জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি টার্মিনালটি চালু হতে পারে।

জ্বালানি বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এটিকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয় মেরামত করার জন্য। এরপর কয়েকবার চালুর কথা বলা হলেও সামিট ব্যর্থ হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রায় ৩ মাস ধরে একটা টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাস সংকট প্রকট হয়েছে। সামিটের টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় জুলাইয়ে স্পট মার্কেট থেকে কেনা চারটি এলএনজি কার্গো সরবরাহের আদেশ বাতিল করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সামিটের টার্মিনালটি চালুর বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় জানতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি সচিব নুরুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সামিটের টার্মিনালটি বন্ধ। এতে গ্যাস সংকট বেড়েছে। পেট্রোবাংলাকে বলা হয়েছে সামিটকে চিঠি দিয়ে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করতে। তা না হলে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে আরপিজিসিএল সামিট গ্রুপকে চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিকল টার্মিনাল সচল করার বিষয়ে সামিট গ্রুপ অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। টার্মিনাল দীর্ঘ সময় বিকল থাকায় দেশের ক্ষতি হচ্ছে। কবে নাগাদ টার্মিনাল মেরামত করে পুনঃস্থাপন করা যাবে, সে সম্পর্কে সামিটের পরিকল্পনা ১ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সামিটের মেরামতের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা হতাশাজনক। এলএনজি টার্মিনাল বিকল হওয়ায় বিদ্যুৎ, সার এবং শিল্প খাতে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কয়েক দিন আগে সামিট বিবৃতিতে জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে কয়েকশ টন ওজনের একটি ইস্পাতের পন্টুন টার্মিনালে আঘাত করে। এতে টার্মিনালের হাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্যালাস্ট ওয়াটার ট্যাংকে পানি ঢুকে যায়। তবে কর্মীদের চেষ্টায় টার্মিনাল ও কার্গো বাঁচানো সম্ভব হয়। এর পর টার্মিনালটির কার্যক্রম বন্ধ করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় মেরামতের জন্য। ১০ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে কক্সবাজারের মহেশখালীতে ফিরে আসে এফএসআরইউ। পরদিন ডিসকানেক্টেবল টারেট মুরিং (ডিটিএম) প্লাগের সংযোগের সময় বয়া মেসেঞ্জার লাইনে একটি অপ্রত্যাশিত জট বাঁধে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডিটিএম হস্তান্তরে একটি শক্তিশালী ও উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনের জন্য ডাইভিং সাপোর্ট ভেসেলের (ডিএসভি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সামিট, যা ২২ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে মহেশখালীতে পৌঁছেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আবহাওয়া ও সমুদ্র পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে আগস্টের শেষে ডিটিএম প্লাগের পুনঃস্থাপন ও পুনঃসংযোগ সম্পন্ন করবে সামিট। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে টার্মিনালটি চালু হতে পারে।

২০১৮ সাল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। প্রথমে এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করতে থাকে সরকার। পরে ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে সামিটের এফএসআরইউ। এর দৈনিক রিগ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম