সংস্কার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ঢেলে সাজাতে হবে দুদক
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুষ্টচক্র ভেঙে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর দাবি উঠেছে সংস্থাটির ভেতর থেকেই। এর সঙ্গে একমত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরাও। সংস্কারের অংশ হিসাবে দুদকের বিধিমালার ৫৪(২) বিধি বাতিল করতে হবে। বন্ধ করতে হবে প্রেষণে নিয়োগ। সংশোধন করতে হবে আইনের আরও বেশ কিছু ধারা। অন্যদের মতো দুদক কর্মকর্তাদেরও সম্পদের হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে ওয়েবসাইটে দিতে হবে। অভিযোগ বাছাইয়ে দুদকের দুষ্টক্ষত দূর করতে হবে। আসামির বিদেশ যাত্রা বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর্মকর্তাদের কাজ মনিটরিংয়ের জন্য গঠন করতে হবে শক্তিশালী কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। অনুসন্ধান ও তদন্তে গতি আনতে এনআইডি, ব্যাংক ও এনবিআর সার্ভারে দুদক কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের পাশাপাশি সংস্কারের জন্য ১৪ দফা দাবিসংবলিত একটি লেখা কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জার গ্রুপে চালাচালি হচ্ছে। যুগান্তরের হাতে আসা লেখাটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বেশির ভাগ দাবিকেই যৌক্তিক বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবাজদের কাছে ছিল আতঙ্ক। দুদকের ভয়ে অনেকেই রাস্তায় বিলাসবহুল গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলেও পালিয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে কাজের সুযোগ পেলে ‘রাঘববোয়াল’ ধরার নজির আছে সংস্থাটির। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখিয়ে দেশ এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ এসেছে দুদকের সামনে। এজন্য সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানো খুবই জরুরি।
দুদকের ত্রৈমাসিক বার্তা নামের সাময়িকীতে তুলে ধরা পরিসংখ্যান মতে, গত তিন মাসে সংস্থাটি ১১০০ কোটি টাকা জব্দ করেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেকটা ‘অকার্যকর’ দুদক যদি এই কাজ করে তবে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দুদককে কাজে লাগালে দুর্নীতিবাজরা পালানোর পথ পাবে না। কাজেই দুদকে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। উদাহরণ তুলে ধরে এক কর্মকর্তা বলেন, ১/১১-এর সরকার শুরু থেকেই দুর্নীতি দমনে কঠোর হওয়ায় দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা কোনো ষড়যন্ত্র করার সুযোগ ও সাহস পায়নি। তখন তালিকা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চলেছে। কিন্তু এবার এখনো দুর্নীতি রোধে গোছানো কোনো অভিযান শুরু না হওয়ায় দুর্নীতিবাজরা নিরাপদে থেকে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। যাতে সর্বস্তরে নেতৃত্ব ও পেশাদারিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। কাজটি যদিও কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অনেক প্রাণের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের সেই সৎসাহস আছে বলে আমি মনে করি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নেতৃত্ব পর্যায়ে যারা আছেন, বিশেষ করে কমিশনে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের অনেকেই আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধি। তাদের বিরুদ্ধে দলীয়করণ, দলীয় প্রভাব ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। সার্বিকভাবেই প্রতিষ্ঠানটিতে দলীয় প্রভাবে প্রভাবিত করে রাখা হয়েছে। এটা নতুন নয়। শুরু থেকেই এই সংকট ছিল। গত ১৬ বছরে এই সংকট ঘনীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর হয়ে গেছে। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধে কখনো দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কোনো না কোনো কারণে যদি কেউ ক্ষমতাশালীদের রোষানলে পড়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত লম্ফঝম্পের মাধ্যমে নাজেহাল করা হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতেন তারা কোণঠাসা হয়ে আছেন। কাজেই পুরো প্রতিষ্ঠানটাকেই এখন ঢেলে সাজাতে হবে। আর কিছু কিছু আইনের সংশোধন করতে হবে।’
কর্মকর্তাদের ভাষ্য-দুদকের সব ক্ষমতা চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের ওপর ন্যস্ত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব পদে নিয়োগ পান আমলারা। দুদকের কাজ সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা থাকে না। তাই দুদকের কাজ ও সংশ্লিষ্ট আইন জানে এমন কাউকে এই পদে বসানো উচিত। এক্ষেত্রে একজন জুডিশিয়ারির সদস্য ও দুজন দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তার মাধ্যমে কমিশন গঠন করা দরকার। তাছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে থাকা ব্যক্তিদের এসব পদে বসালে তারা ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে গিয়ে সংস্থার সুনাম দুর্নাম নিয়ে ভাবেন কম।
জানা গেছে, বর্তমানে সংস্থাটির নিজস্ব কর্মকর্তারা অনেকটা কোণঠাসা। কর্মকর্তারা মনে করেন-তাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, বাইরে থেকে প্রেষণে ‘ভাড়াটে’ কর্মকর্তা নিয়োগ । দুদককে প্রশাসন ক্যাডারের অনেকেই পছন্দের পোস্টিং হিসাবে বিবেচনা করেন। নিজ নামে, পরিবারের নামে কিংবা নিজ ক্যাডারের লোকজনকে দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে দুদকে পোস্টিং নেওয়াই যেন তাদের মূল লক্ষ্য। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে-প্রেষণে আসা এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক কখনো কোনো আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না। তাই সহজেই তারা অপকর্ম করে দুদকের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে চলে যায়। সংস্থাটিকে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান করতে হলে শুধু লিগ্যাল উইংয়ে জুডিশিয়ারি থেকে একজন ডিজি ছাড়া সব ধরনের প্রেষণ বন্ধের দাবি উঠেছে। জানা গেছে, বর্তমানে দুদকে প্রেষণে কর্মরত আছেন ৫২ জন। এর মধ্যে ২২ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অন্যরা পুলিশ, কাস্টমস, জুডিশিয়ারিসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে এসেছেন। জানা গেছে, দুদক বিধিমালার ৫৪(২) বিধি অনুযায়ী কমিশন কোনো ধরনের কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে যে কোনো কর্মকর্তাকে যে কোনো সময় অব্যাহতি দিতে পারেন। এই বিধির ভয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের যে কোনো অন্যায় তদবির মেনে নিতে বাধ্য হন। তাই এটা বাতিল করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে দুদকের সাবেক পরিচালক নাসিম আনোয়ার যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রেষণে নিয়োগ বন্ধের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। কারণ-প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা দুদকের তদন্ত ও অনুসন্ধান কাজকে অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করে। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তারা অনেক সময় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে দুদককে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। তাছাড়া যারাই যে ক্যাডার থেকে আসেন তারা তাদের ক্যাডার অফিসারদের সুরক্ষা দেন। নিজস্ব ক্যাডার অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেগুলো তারা সযত্নে এড়িয়ে যান। আবার ক্ষেত্রবিশেষ ব্যাচমেট যাদের সঙ্গে শত্রুতা থাকে তাদের দুদক দিয়ে শায়েস্তা করার নজিরও আমি দেখেছি। এ কারণে আমি মনে করি দুদকে প্রেষণ বন্ধ করা উচিত। আর দুদক বিধিমালার ৫৪(২) ধারা থাকা উচিত নয়। এটা কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে। প্রচলিত নিয়মে অন্যান্য বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে প্রক্রিয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেভাবেই দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতিলব্ধ আয় দিয়ে সম্পদ করার সুযোগ না থাকলে কেউ দুর্নীতি করত না। প্রতিবছর সম্পদের তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক ও ওপেন করা উচিত। যা সব সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। একইভাবে দুদকে কর্মরত কর্মকর্তাদেরও সম্পদের তথ্য প্রতিবছর প্রকাশ করতে হবে। তাহলে সবার কাজে স্বচ্ছতা আসবে। এছাড়া দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করতে হবে।’
আরও জানা গেছে, দুদকে প্রতিদিন গড়ে অভিযোগ জমা পড়ে প্রায় ৫ হাজার। এসব অভিযোগ বাছাই করে এনফোর্সমেন্ট ও অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হয় মাত্র ১০-১২টি। মূলত এটিই দুদকের দুষ্টচক্র। কেন্দ্রীয়ভাবে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটির (যাবাক) প্রধান সব সময় থাকেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি দুদকের অসীম ক্ষমতার মালিক। যাবাক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। তাই যাবাক-এর কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে সীমাবদ্ধ না রেখে জেলায় জেলায় ভাগ করে দেওয়া উচিত। জেলায় যেসব অভিযোগ বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেগুলো কেন্দ্রীয় যাবাকের অনুমোদনের দরকার না থাকার বিধান করার দাবি উঠেছে। যে কোনো তদন্ত ও অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা যেন নিতে পারেন-সেই দাবি উঠেছে। কারণ-কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকায় কোনো অভিযোগকারী অভিযোগ পাঠানোর পর ৩-৬ মাসেও তা অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য নেওয়াা হয় না। দুদকের কাজে গতি আনতে হলে এটি সবার আগে দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া তদন্ত সংস্থা হিসাবে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ অফিস, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ব্যাংকিং ও আয়কর বিভাগের সার্ভারে প্রবেশাধিকার নেই দুদক কর্মকর্তাদের। ফলে অনুসন্ধান ও তদন্তে ঘাটতি থাকে। থেমে যায় গতি। বর্তমান ডিজিটাল যুগেও দুদক অফিসারদের ডাকযোগে চিঠি লিখে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্য চাইতে হয়। ফলে ৬ থেকে ১ বছরেও তদন্ত কাজ শেষ হয় না। তাই তদন্তে গতি আনতে এসব সার্ভারে প্রবেশাধিকার চায় দুদক।
জানা গেছে, কমিশন ও আদালতের অনুমতি ছাড়া দুদক অফিসার কোনো আসামির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন না। ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধকরণের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। কমিশন ও আদালতের অনুমতি নিতে ১৫-২০ দিন চলে যায়। এই সুযোগে অপরাধী পার পাওয়ার সুযোগ পায়। তাই দুদক অফিসার তার নিজ ক্ষমতাবলে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ ফ্রিজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে ববস্থা নেওয়ার পরবর্তী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তারা যেন আদালতে আবেদন করে অনুমতি নিতে পারে এমন ব্যবস্থা রাখা। এটা হলে কোনো অপরাধী পার পাবে না।
এছাড়া পদোন্নতির জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের মতো যুগোপযোগী অর্গানোগ্রাম করারও দাবি উঠেছে। দুদক আইন অনুযায়ী নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দুদকের সচিব হওয়ার কথা। কিন্তু দুদক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সচিব পদে যারা বসেছেন তাদের সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ফলে তারা রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে থেকেই কাজ করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই পদে দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের বসানোর দাবি উঠেছে। দুদক আইন ও বিধিমালার যুগোপযোগী সংশোধনের কথাও বলা হচ্ছে। এছাড়া সোর্স মানি, ঝুঁকি ভাতা, বেতন কাঠামোসহ আরও ৫ ধরনের সংস্কারের দাবি উঠেছে।