Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বদলি বাণিজ্যের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে

ভ্যাট চালান ও পে-অর্ডার নিয়েও জালিয়াতি

সবাই এখন ভোল পালটাতে ব্যস্ত তদন্তের দাবি ভুক্তভোগীদের * বেশির ভাগ জমির ক্রেতা ও বিক্রেতা আইনকানুন বোঝেন না

Icon

বিএম জাহাঙ্গীর

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভ্যাট চালান ও পে-অর্ডার নিয়েও জালিয়াতি

ছবি: সংগৃহীত

সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ভ্যাট চালান ও পে-অর্ডার নিয়ে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়। বাস্তবে যা লাগবে এর চেয়ে বেশি খরচ দেখিয়ে অতিরিক্ত ভ্যাট চালান ও পে-অর্ডার করা হয়। দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার পর চক্রটি বাড়তি অর্থ বিশেষ কৌশলে নগদায়ন করে পকেটস্থ করে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত।

এদিকে নিবন্ধন অধিদপ্তর বা আইজিআর অফিস এবং জেলা রেজিস্ট্রার ও সাবরেজিস্ট্রারদের একটি শক্তিশালী চক্র দীর্ঘদিন ধরে বদলি বাণিজ্যের মিডিয়া হিসাবে যুক্ত। এ চক্রের সঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার ভাগবাঁটোয়ারার সম্পর্ক ছিল। যদিও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ বদলির ক্ষেত্রে এক ধরনের অলিখিত বাণিজ্য হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমন কিছু বদলি বাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট তথ্য যুগান্তরের হাতে এসেছে।

ভ্যাট চালান ও পে-অর্ডার জালিয়াতি : সূত্রগুলো জানায়, উদাহরণস্বরূপ বাস্তবে যদি লাগে ১ লাখ টাকার ভ্যাট ও পে-অর্ডার, সেখানে জমির ক্রেতার কাছে হিসাব দেখানো হয় ২ লাখ টাকার। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ ক্রেতাদের বেশি কিছু বলার থাকে না এজন্য যে, তিনি দেখেন তার সামনেই পে-অর্ডার করা হয়েছে। এমনকি বিশ্বাস অর্জনের জন্য পে-অর্ডার ও ভ্যাটের ফটোকপিও দিয়ে দেওয়া হয়। 

এছাড়া বেশির ভাগ জমির ক্রেতা ও বিক্রেতা জমিজমাসংক্রান্ত আইনকানুন তেমন একটা বোঝেন না। এসব কারণে দলিল লেখকরা যা খরচ বলেন, সেটা অনেকে মেনে নেন। কিন্তু শুভংকরের ফাঁকি হলো-পে-অর্ডারে যখন সাবরেজিস্ট্রার সিল ও স্বাক্ষর করেন, তখন কৌশলে অতিরিক্ত পে-অর্ডারে সিল স্বাক্ষর করেন না, বা সাবরেজিস্ট্রারকে করতে দেওয়া হয় না। 

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত থাকে, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট দলিল লেখক এবং উমেদার নামধারী সাবরেজিস্ট্রারের নির্ধারিত ক্যাশিয়ার অতি সূক্ষ্মভাবে কাজটি সম্পন্ন করেন। এরপর সাবরেজিস্ট্রারের সিল স্বাক্ষরবিহীন পে-অর্ডার ও ভ্যাটের চালান পুনরায় ব্যাংকে গিয়ে টাকা নগদায়ন করা হয়। এজন্য আগে থেকে এসব চালান ও পে-অর্ডার অনলাইনে পোস্টিং দেওয়া হয় না। 

এখানে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট চক্র অলিখিত কমিশন পেয়ে থাকে। প্রতিটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন হরহামেশা এ ধরনের জালিয়াতি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আবার জাল ভ্যাটের চালান প্রস্তুত করা হয়। এ কাজে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের সামনে অবস্থিত কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান জড়িত। সূত্র জানায়, স্ট্যাম্প ডিউটি, আয়কর অধ্যাদেশের ১২৫ ধারা অনুযায়ী গেইন ট্যাক্স, রেজিস্ট্রেশন ফি ১%, স্থানীয় কর ২% এবং উপজেলা কর ১% পরিশোধের জন্য পে-অর্ডার দিতে হয়। 
অপরদিকে ভ্যাট দিতে হয় ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে প্লট কিনলে এবং ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে প্রথম বিক্রির সময়। যারা জাল-জালিয়াতিতে যুক্ত, সেসব দলিল লেখক ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে বেশি টাকা নিয়ে থাকেন। আবার অনেক সময় সৎ সাবরেজিস্ট্রারের কারণে দলিল লেখকরা জাল-জালিয়াতি করতে পারেন না। জালিয়াতি করে টাকা নিতে চাইলেও তা ফেরত দিতে হয়। টাকা ফেরত দেওয়া প্রমাণিত অনেক ঘটনা আছে।

রমরমা বদলি বাণিজ্য : রেজিস্ট্রেশন বিভাগজুড়ে শুরু থেকেই বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, যা অনেকাংশে সত্য। আর এ ধরনের বদলি বাণিজ্য কখনো সামনে আসে না। এর প্রধান কারণ-যিনি ঘুস দিয়ে প্রাইজ পোস্টিং নেন, তিনি তো নিজে লাভবান হন। এখানে উভয় পক্ষ লাভবান হয় বিধায় কেউ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না। 

এ সুযোগে যারা প্রভাবশালী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, তারা বদলি বাণিজ্যের জন্য যথাযথ চ্যানেল মেইনটেইন করে কাজ হাতিয়ে নেন। আর এ বদলি বাণিজ্য সব আমলে কমবেশি বলবৎ ছিল। তবে বিগত সরকারের আমলে সব সীমা ছাড়িয়েছে। 

এ চক্রের প্রধান ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের অতি ঘনিষ্ঠভাজন এক আইনজীবী। যাকে নিয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সবাই তাকে একনামে চেনেন। ‘ত’ আদ্যাক্ষরের এই ক্ষমতাধর নারীর পরিচয় কখনো আইনজীবী, কখনো আবার মানবাধিকারকর্মী। তার ছেলে থাকেন কানাডায়। সেখানে তার শত শত কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে। 

রহস্যময়ী এই প্রভাবশালী নারী আইন মন্ত্রণালয় কিংবা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কোনো পদে বা কাজে যুক্ত ছিলেন না। অথচ তিনিই ছিলেন অনেক কাজের আসল কাজি। তার তদবিরে এ মন্ত্রণালয়ের অধীন যে কোনো কাজ দ্রুত হয়ে যেত বলে দুর্নীতিবাজরা সবাই ছুটতেন তার ডেরায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতেন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা। এ তদবির চেইনের নিচের ধাপে সহযোগী ছিলেন আইজিআর অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং দুইজন জেলা রেজিস্ট্রার। যাদের একজন সাময়িক বরখাস্ত এবং অপরজন ঢাকার বাইরে কর্মরত। 

জানা যায়, শুধু জেলা রেজিস্ট্রার কিংবা সাবরেজিস্ট্রার পদ নয়, অফিস সহকারী বা কেরানি বদলিতেও মোটা অঙ্কের ঘুস লেনদেন হয়। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর কেরানি হতে পারাটাও বড় সৌভাগ্যের। এজন্য বেশির ভাগ কেরানি বদলিতে ঘুস লেনদেন হয়। এ ধরনের কয়েকটি বদলির কাগজ যুগান্তরের হাতে এসেছে। 

যেমন : ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের মধ্যে বদলি প্রজ্ঞাপন, গত ১৮ এপ্রিল ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী ও চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের প্রধান সহকারী বদলির প্রজ্ঞাপন, ১৬ এপ্রিল কেরানীগঞ্জ দক্ষিণের সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক জাহাঙ্গীর আলমকে মোহাম্মদপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে এবং আশুলিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক মো. হেলালকে সূত্রাপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বদলি। এছাড়া এভাবে আরও বেশকিছু বদলি বাণিজ্যের প্রজ্ঞাপন যুগান্তরের হাতে এসেছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ৬ জুন জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ১৩ জন প্রধান সহকারী রদবদল এবং ১৮ এপ্রিল জারি করা ৭ জন প্রধান সহকারীর রদবদলের প্রজ্ঞাপন উল্লেখযোগ্য। 

সূত্র জানায়, সবচেয়ে বড় ধরনের বদলি বাণিজ্য হয় বেশ কয়েক বছর আগে। তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিএস ছিলেন ‘ম’ আদ্যাক্ষরের একজন। আনিসুল হক একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত হলেও অভিযোগ আছে, সেসময় সব কাজের কাজি ছিলেন তিনি। আইন মন্ত্রণালয় ও রেজিস্ট্রেশন বিভাগের অনেকে দাবি জানিয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন বহুল আলোচিত ওই পিএস-এর বিষয়ে অনুসন্ধান করলে থলের সব কালো বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তিনি কোনো ক্যাডার কর্মকর্তা ছিলেন না। সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব জনবল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে মন্ত্রী তাকে পিএস হিসাবে নিয়োগ দেন। তার বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। আইনমন্ত্রীর পিএস হওয়ার আগে তার কী পরিমাণ সম্পদ ছিল এবং পরে তার সম্পদ কত বেড়েছে, সেটির হিসাব জানতে চান অনেকে। 

বিভাগীয় মামলা : বর্তমানে ৩ জন জেলা রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান আছে। তারা হলেন সাবেক কুড়িগ্রামের সাবরেজিস্ট্রার এইচএম মোজাহিদুল ইসলাম, কুমিল্লার সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম এবং ফরিদপুরের সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার আলী আকবর। 

অপরদিকে সাবরেজিস্ট্রারদের মধ্যে ভালুকার আসমা আক্তার, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পারভীন আক্তার, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের নুরুল ইসলাম, গাজীপুর সদরের মনিরুল ইসলাম এবং মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের রেহেনা বেগমের নামে বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। তাদের প্রায় সবাই নিবন্ধন অধিদপ্তরে সংযুক্ত। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, এর বাইরেও অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তদন্ত কিংবা বিভাগীয় মামলা করা হয়নি।

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ
‘ওরা সবাই টাকার মেশিন পদে ছোট সম্পদে বড়’ শিরোনামে ১২ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলিল লেখক এমএ রশিদ। তিনি দাবি করেন, এ সংবাদে তিনিসহ দলিল লেখক আবু তাহের, ফিরোজ আলম ও আক্তারুজ্জামান বুলবুলের নাম উপস্থাপন করা সঠিক হয়নি। 

প্রতিবেদকের বক্তব্য : সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রিপোর্ট করা হয়েছে। বরং দলিল লেখকদের অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে। জাল-জালিয়াতি ছাড়াও বেশ কয়েকজন দলিল লেখকের অঢেল সম্পদের প্রকৃত উৎস জানতে যুগান্তরের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম