Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অধরা রেজিস্ট্রেশন বিভাগ (২)

ওরা সবাই টাকার মেশিন পদে ছোট সম্পদে বড়

Icon

বিএম জাহাঙ্গীর

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওরা সবাই টাকার মেশিন পদে ছোট সম্পদে বড়

ফাইল ছবি

সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যারা পদ-পদবিতে ছোট চাকরি করেন, তাদের অনেকের বাড়তি আয়-রোজগার বেশি। এছাড়া দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি আর তদবির বাণিজ্যে একধাপ এগিয়ে একশ্রেণির দলিল লেখক ও বাইরের দালালচক্র। সব মিলিয়ে তারাই একেকজন টাকার মেশিনে পরিণত হয়েছেন। দেশের প্রতিটি সাবরেজিস্ট্রি অফিসের প্রায় একই চিত্র। তবে সবচেয়ে বড় দপ্তর হলো ঢাকার তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স। এখানে এক ছাদের নিচে রয়েছে ১০টি সাবরেজিস্ট্রি অফিস। এছাড়া আছে সদর রেকর্ড রুম। ঢাকা জেলা সাবরেজিস্ট্রারের অধীনে রেজিস্ট্রি অফিসের সংখ্যা ২২টি। সবই নিয়ন্ত্রণ হয় এই কমপ্লেক্স ভবন থেকে।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাইব্রিড বিএনপিপন্থিদের দাপটে অস্থির তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স। এখানে প্রায় প্রতিদিনই এ চক্রের সদস্যরা দলবেঁধে মহড়া দিচ্ছেন। আর যে যেভাবে পারছেন কট্টর আওয়ামীপন্থি দলিল লেখক, উমেদার ও নকলনবিশদের সিট দখল করে নিচ্ছেন।

সূত্র জানায়, দলিল রেজিস্ট্রি হলো একটি খুশির বিষয়। যিনি বিক্রি করেন, তিনি বিক্রির টাকা পেয়ে যেমন খুশি; তেমনই যিনি জমি বা সম্পদ কেনেন, তিনিও কিনতে পেরে খুশি হন। যে কারণে জমি কেনাবেচার সময় উভয় পক্ষ খুশি হয়ে দলিল রেজিস্ট্রিসংশ্লিষ্টদের হিসাবের বাইরে বকশিশ দিয়ে থাকেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে খুশি মনের বকশিশের অঙ্ক ঠিক থাকে না। নানারকম ভুলত্রুটির সুযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মোটা অঙ্কের ঘুস আদায় করেন। এছাড়া জাল-জালিয়াতির বিষয় হলে তো কথাই নেই। একেবারে হামলে পড়ে ঘুসখোর চক্রগুলো। সেখানে মোটা অঙ্কের দালালি আর ঘুসের চুক্তি করা হয়। এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখেন দলিল লেখক ও উমেদাররা। এর প্রথম কারণ দুটি। প্রথমত, যিনি জমি রেজিস্ট্রি করবেন, তাকে প্রথমে একজন দলিল লেখকের কাছে যেতে হবে। আর দলিল লেখক মানে একজন আইনজীবীর মতো ব্যক্তি। তিনি কিন্তু সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করেন না। শুধু দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য ডিআর বা জেলা রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে থাকেন। তাই তার ওপর তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না সাবরেজিস্ট্রারদের। এজন্য প্রথম ক্রাইম শুরু হয় দলিল লেখকের হাত দিয়ে। এরপর সেখানে যুক্ত হন উমেদার। উমেদার পদটি চাকরি হলেও সেটি মাস্টার রোলে। ছুটির দিন ছাড়া কাজ করলে দৈনিক ৬০ টাকা মজুরি পান। বর্তমান যুগে একজন ভিক্ষুক যেখানে দৈনিক ২/৩শ টাকা ভিক্ষা পান, সেখানে দৈনিক ৬০ টাকা মজুরি বড়ই হাস্যকর। তবু রেজিস্ট্রি অফিসগুলোয় উমেদারের চাকরি পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ উমেদারদের মাধ্যমে বেশির ভাগ ঘুসের দেনদরবার ও লেনদেন হয়ে থাকে। এজন্য রেজিস্ট্রি অফিসগুলোয় সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সম্পৎশালী হলেন একশ্রেণির দলিল লেখক ও উমেদার। কেউ কেউ শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কারও কারও ঢাকা শহরে মূল্যবান সহায়সম্পত্তির অভাব নেই। অথচ তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর কথা। ফলে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সজুড়ে তাদের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। এর পরের ধাপে রয়েছে নকলনবিশ, অফিস সহকারী বা কেরানি, মোহরার, অফিস সহায়ক বা পিওন, নৈশপ্রহরী ও ঝাড়ুদার এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের টিসি মোহরার বা রাজস্ব আদায়কারী। তারা সবাই কমবেশি অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। বেশির ভাগ নৈশপ্রহরী টিপসই নেওয়া ও দলিল কমিশনের কাজ করেন। এছাড়া দলিল তল্লাশিকারকসহ রেকর্ড রুমের কর্মচারীরাও এসব অপকর্মে জড়িত। অভিযোগ আছে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয় রেকর্ড রুমে। এখানে কর্মরত দলিল তল্লাশিকারক ও উমেদাররা বেশি প্রভাবশালী। তাদের অনেকে টাকার বিনিময়ে দলিল টেম্পারিং ও গায়েব করার মতো কাজ করে থাকেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে প্রভাবশালী দলিল লেখকদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদপুরের এমএ রশীদ, ঢাকা সদরের নাসীর উদ্দিন, বশীর উদ্দিন, শামসুল আরেফিন, বাড্ডার আতিকুল্লাহ ও আহসানউল্লাহ, মোহাম্মদপুরের আবু তাহের, ফিরোজ আলম, আখতারুজ্জামান বুলবুল, সদরের দলিল লেখক ও খিলগাঁওয়ের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, পল্লবীর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাকিল প্রমুখ। অপরদিকে প্রভাবশালী উমেদারদের মধ্যে পল্লবীর মোসলেম, মোহাম্মদপুরের বাবু, বাড্ডার ফারুক, খিলগাঁওয়ের মেহেদী, শাহীন প্রমুখ। তাদের মধ্যে উমেদার জাহাঙ্গীর কয়েক মাস আগে সূত্রাপুর থেকে মোহাম্মদপুরে বদলি হয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া মোহাম্মদপুরের পিওন জাহাঙ্গীরও বেশ প্রভাবশালী।

দলিল কমিশনে বড় বাণিজ্য : দলিল কমিশন করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক বা পিওন এবং বড়জোর এক্সট্রা মোহরাররা করে থাকেন। তবে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দলিল কমিশনে হচ্ছে বড় ধরনের আয় বাণিজ্য। নানান অজুহাতে মোটা অঙ্কের ঘুসের দেনদরবার করা হয় কমিশনে। বিশেষ করে যাদের খুব জরুরি কমিশন করা প্রয়োজন তাদের ক্ষেত্রে নানারকম ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে চুক্তিতে বেশি টাকা আদায় করা হয়।

ভোল পালটানো কর্মচারী : সারা বছর আওয়ামী লীগ করলেও এখন বিএনপিপন্থি সেজে ইতোমধ্যে মাঠে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সদরের নকলনবিশ শাহীন, পল্লবীর নকলনবিশ অপু, জাহিদ, কাউসার, সাবিনা ও পারুল। ২-৩ দিন ধরে তাদের মধ্যে কেউ কেউ দল বেঁধে হানা দিয়ে সিট দখল বাণিজ্য শুরু করেছেন। এমনকি কেউ কেউ সশস্ত্র অবস্থায় ভেতরে ঢুকে মস্তানি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ বিগত সরকারের আমলে তারা জাঁকজমকভাবে ১৫ আগস্ট পালন করেন। আওয়ামীপন্থি সেজে রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে ছড়ি ঘুরিয়েছে। এছাড়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীদের বেশির ভাগ নিজের ওপর অর্পিত কাজ ফেলে সারাক্ষণ ঘুস কারবারে বেশি ব্যস্ত থাকেন। সরেজমিন অনুসন্ধান করতে চাইলে যে কারও চোখে এমন দৃশ্য ধরা পড়বে।

শুধু অফিস খরচের নামে ঘুস : সূত্র বলছে, তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে গড়ে প্রতিদিন ৫শ দলিল রেজিস্ট্রি হয়। দলিলপ্রতি ঘুস আদায় হয় গড়ে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন ঘুস আদায় হয় ৫০ লাখ টাকা। সাপ্তাহিক দুদিনের ছুটি বাদ দিলে মাসে ২২ কার্যদিবসে ঘুস আদায়ের পরিমাণ কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। এছাড়া বড় ধরনের জালজালিয়াতি তো আছেই। সেখানে লাখ লাখ টাকার ঘুসের চুক্তি হয়। আর এ বিপুল অঙ্কের ঘুসের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয় প্রভাবশালী নেটওয়ার্কজুড়ে। ঘুসের ৫০ শতাংশ চলে যায় কতিপয় অসাধু সাবরেজিস্ট্রারের পকেটে। এছাড়া এসব টাকার ভাগ পান দলিল লেখক, উমেদার, নকলনবিশ, অফিস সহকারী, মোহরার, এক্সট্রা মোহরার ও পিওন। কতিপয় উমেদারের ওপর পুরো নেটওয়ার্কের ঘুস আদায় এবং বণ্টনের দায়িত্ব অর্পিত। অবশ্য এর বাইরে বড় বড় কিছু বিশেষ জমি রেজিস্ট্রির বিষয় থাকে। যেখানে থাকে বড় ধরনের ফাঁকফোকর। করা হয় জালজালিয়াতি। ভুয়া নামজারিসহ প্রয়োজনীয় আরও কিছু জাল কাগজপত্র সৃষ্টি করে জমি রেজিস্ট্রি হয়। সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিতে ভিটি শ্রেণিকে নালা ও ডোবা হিসাবে দেখানো হয়। অনেক সময় ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রির সময় সিস্টেম করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুসের চুক্তি করা হয়। অনেক সময় জালজালিয়াতি করে রেজিস্ট্রি হওয়ার পর ওই দলিল দিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে সমাজের প্রভাবশালীদের বিশেষ হাত থাকে।

ঘুস দিতে হয় যেসব কাজে : জমির শ্রেণি পরিবর্তন নিষিদ্ধ হলেও ঘুস দিলে কোনো কিছু ‘অসম্ভব নয়’। বড় অঙ্কের ঘুস পেলে নাল জমিকে ভিটি, ভিটি জমি মুহূর্তেই বাড়িতে রূপান্তর হয়ে যায়। ওয়ারিশ নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় ঘুস লেনদেন অবধারিত। দলিলের নকল, ভোটার আইডি জটিলতা ইত্যাদি কাজে ঘুস বাণিজ্য বেশুমার। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রিতে স্থানীয় কর, উৎসে কর এবং ৫৩/এইচ ও ৫৩/এফএফ নিয়ে অস্পষ্টতার সুযোগে দুর্নীতি চলছে মহাসমারোহে। আবার পে-অর্ডার নিয়ে সরকারি গেজেটেও রয়েছে ধোঁয়াশা। কোন দলিলে উৎসে কর দিতে হবে, কোনটায় দিতে হবে না, কীভাবে দিতে হবে-তা জানেন না অনেকেই। এর সুযোগ নিচ্ছেন দুর্নীতিবাজরা।

বকশিশের নামে ঘুস : রেজিস্ট্রি অফিসে বকশিশ বা শুভকাজের মিষ্টি খাওয়ানোর খরচ কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। এর উপরে যে যা নিতে পারেন। রেজিস্ট্রির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুসের লম্বা ফর্দ শোনা যায় দালাল-কর্মচারীদের মুখে মুখে। যেমন রেজিস্ট্রির পর দলিলে টিপসই দেওয়া হলেই তাৎক্ষণিক এক হাজার টাকা দেওয়া দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। তাই আঙুলের ছাপ নেওয়ার পরপরই টাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মচারী। এমনকি দলিলের বান্ডিল সেলাইয়ে আছে বিশেষ বকশিশ। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে পে-অর্ডার করতে বকশিশের নামে ঘুস আদায়ের রেওয়াজ সম্প্রতি চালু হয়েছে।

রেকর্ড রুমের ঘুস কারবার : রেকর্ড রুমে ভলিউম যাচাই বা নকল তুলতে ঘুস লেনদেন ওপেন সিক্রেট। সরকারি ফি যৎসামান্য হলেও নকলের সর্বনিু ঘুস পাঁচ হাজার টাকা। এর উপরে যে যা নিতে পারেন। এর মধ্যে ২৭০ টাকা আদায় করা হয় সেরেস্তা ফি হিসাবে। এ টাকার পুরোটাই ঘুস। যার ভাগ চলে যায় নকলনবিশ ও তল্লাশিকারকদের পকেটে। অথচ অনেকেই জানেন ‘সেরেস্তা ফি’ হলো সরকারি রাজস্ব।

উমেদাররা কেন বেশি ক্ষমতাধর : রেজিস্ট্রি অফিসের ঘুস চ্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছে অসাধু ‘উমেদার’ সিন্ডিকেট। সাবরেজিস্ট্রারের খাসকামরায় তাদের অবাধ যাতায়াত। রেকর্ডরুমসহ মূল্যবান দলিলদস্তাবেজও তাদের কবজায়। এ কারণে উমেদারদের অনেকেই প্রভাবশালী। এমনকি তাদের অনেকে হাত মিলিয়েছেন দলীয় রাজনীতি ও স্থানীয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে।

যে তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি : ২০২০ সালের ২ মার্চ বাড্ডা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি রাসেল মিয়ার ইন্ধনে অফিসের নকলনবিশ মো. হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে উমেদার নাসির আলীর মারামারি হয়। ওই ঘটনা তদন্তে বাড্ডা ও মোহাম্মদপুর সাবরেজিস্ট্রারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যথারীতি ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেন সাবরেজিস্ট্রার লোকমান হোসেন ও মনিরুল ইসলাম। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তৎকালীন জেলা সাবরেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম