বিএসএমএমইউতে ধ্বংসযজ্ঞ আগুন
বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলে আগুন * রোগী-স্বজন ও চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও আগুনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্স, স্টাফ বাস, মোটরসাইকেলসহ অর্ধশত যানবাহন আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনিক ভবনের রিসিপশনসহ বিভিন্ন কক্ষের চেয়ার-টেবিল, কাচের স্থাপনাসহ অনেককিছু ভেঙে ফেলা হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, আন্দোলনকারীরা হাসপাতালের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সসহ ৫২টির বেশি গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছেন। রিসিপশনসহ বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর এবং বেশ কয়েকজন কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। রুমে রুমে ঢুকে চিকিৎসকদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে থাকা রোগী, স্বজন এবং চিকিৎসক ও স্টাফদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের এক দফা প্রতিরোধে আগে থেকে শাহবাগে এসে জড়ো হন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ধীরে ধীরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের কয়েকজন শাহবাগে এলে তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার প্রথম সূত্রপাত। আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়লে তারা ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা বিএসএমএমইউ-এর ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা ভেতরে ও ভবনের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীরে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে আন্দোলনকারীরাও পালটা ইটপাটকেল মারেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর প্রশাসনিক ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। ভেতরে থাকা অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বিএসএমএমইউ-এর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সকাল থেকে হাসপাতালের বেশির ভাগ গেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে কিছু লোক হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ সময় বাইরে থাকা আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। একপর্যায়ে গেট ভেঙে শতশত আন্দোলনকারী ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুরসহ ৫২টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় রোগী, স্বজন, চিকিৎসকসহ অন্য স্টাফদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হন। আটজন স্টাফ আহত হয়েছেন, যাদের একজনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় পুলিশকে কল করা হলেও উদ্ধারে কেউ আসেনি। বেলা ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
দুপুর ২টার দিকে হাসপাতালের ডি-ব্লকের পাশ দিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গেলে চোখে পড়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। সরেজমিন দেখা যায়, ভেতরে থাকা অ্যাম্বুলেন্স, স্টাফ বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলসহ বহু গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে আছে। কোনো কোনোটি থেকে তখনও ধোঁয়া বের হচ্ছিল। যে কটি গাড়ি অক্ষত ছিল, সেগুলোরও বেশির ভাগ কাচ ভেঙে ফেলা হয়। স্টাফ বাসগুলো পুড়ে লোহার কঙ্কাল বেড়িয়ে গেছে। মোটরসাইকেলগুলোও পুড়ে লোহা বেরিয়ে গেছে। প্রশাসনিক ভবনের রিসিপশনের কাচ, ডিজিটাল সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রবেশপথে কাচের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। বেশকিছু চেয়ারও ভেঙে ফেলা হয়। একটু সামনে গেলে দেখা যায়, দেওয়ালে টানানো কাচে বাঁধানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্ধশত ছবি আগে থেকেই কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমনটা করেছে বলে মনে হয়েছে। এছাড়া ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেছে।
পাবনা থেকে আসা এক রোগীর স্বজন কবির যুগান্তরকে বলেন, ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর আন্দোলনকারীরা ভেতরে ঢুকে পড়েন। তখন সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রোগী ও স্বজনরা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অনেকে ভয়ে নেমে পড়েন।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী বলেন, আগুনের খবর পেয়ে তারা এসে নির্বাপণ করেন। আগুনে অ্যাম্বুলেন্স, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারসহ অনেক গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ও ভাঙচুর করা হয়। তবে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে মোট ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির সংখ্যা জানাতে পারেনি।
বিএসএমএমইউ-এর প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনকারীরা কয়েকজনকে ধাওয়া দিলে তারা ভেতরে ঢুকে অপরপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন ছাত্ররা ভেতরে ঢুকতে চাইলে হাসপাতালের স্টাফরা তাদের বাধা দেন। স্টাফদের সঙ্গে আন্দোলনকারীর ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের অনেকে ১নং গেট ভেঙে ঢুকে পড়েন। এরপর ৩নং গেট ভাঙার পর শত শত আন্দোলনকারী ভেতরে ঢুকে ডি-ব্লকের সামনে রাখা মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য গাড়িতে আগুন দেন। তিনি বলেন, যানবাহনে আগুন দেওয়ার পর নিচতলার ইনফরমেশন ডেস্ক ভাঙচুর করা হয়। নিচতলার দেওয়ালে রাখা কাচের স্থাপনা ও চেয়ার ভাঙচুর করা হয়। বিভিন্ন রুমে গিয়ে চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের বের করে দেওয়া হয়। তখন রোগী, স্বজন ও চিকিৎসক-স্টাফদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা অনেকে দ্রুত নেমে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন। ঘটনার সময় পুলিশকে কল করা হলেও তারা আসেনি। এছাড়া আমাদের আনসার সদস্যরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি।
ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও স্বাচিপ নেতারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন-আন্দোলনকারীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, তাদের অভিযোগ সত্য নয়। এছাড়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা কেন ভাঙচুর করতে যাবেন। ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে বেলা ১টার পর আন্দোলনকারীরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যান।
এছাড়া প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্ধশত ছবি কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে সঠিক কারণ জানেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক যুগান্তরকে জানান, বিএসএমএমইউতে ছাত্র-জনতার সঙ্গে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা, সংঘর্ষে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।