‘লাশটা পেলেও সান্ত্বনা পেতাম’
নিজের নিরাপত্তার অস্ত্রই কাল হলো বাবুর
তিন আসামির স্বীকারোক্তি: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ভেবে তাকে নির্মমভাবে পেটায়
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিহত জাহিদ এ রহিম বাবু
নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছিলেন রাজধানীর সবুজবাগের বাসিন্দা জাহিদ এ রহিম বাবু (২৫)। কিন্তু এই অস্ত্রই কাল হয়েছে তার। ব্যবসায়িক কাজে কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে যাওয়ার উদ্দেশে গত ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সবুজবাগ পূর্ব বাসাবোর বাসা থেকে বের হন বাবু। ওইদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল উত্তাল। চট্টগ্রাম রোডের যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা ছিল ভয়াবহ।
তিনি শনির আখড়া এলাকায় পৌঁছলে আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় নিজেকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিলেও বিশ্বাস হচ্ছিল না আন্দোলনরতদের। তার কোমরে থাকা অস্ত্রের দিকে নজর পড়ে রাজপথ দখলকারীদের। রিভলবার দেখে তারা মনে করে বাবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। হয়তো তিনি গুলি করে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে এসেছেন। তাই তারা ধাওয়া দেয় বাবুকে। জীবন বাঁচাতে বাবু দৌড়ে পালাতে থাকেন।
ধনিয়া কলেজের সামনে পাকা রাস্তায় যাওয়া মাত্র সেখানে থাকা দুই শতাধিক লোক তাকে লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাত করে। ছিনিয়ে নেওয়া হয় অস্ত্র এবং মোবাইল ফোন। গুরুতর জখমের কারণে তার সাদা ট্রাউজার ও নেভি ব্লু কালারের গেঞ্জি রক্তে ভিজে যায়। লুটিয়ে পড়েন তিনি। মৃত ভেবে তাকে ২০-২৫ জন লোক টেনেহিঁচড়ে কাজলার দিকে নিয়ে যায়। ওই দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজের সন্ধান মিললেও বাবু এখনো নিখোঁজ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, আন্দোলনকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বাবুর কাছে অস্ত্র দেখার পর আন্দোলনকারীরা ভেবেছিল, বাবু সিভিল ড্রেসে আসা একজন পুলিশ সদস্য। তাই তার ওপর নারকীয় হামলা চালানো হয়। নির্মম এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন আসিফ (১৮), শিশির (২৩), সাব্বির হোসেন (২৩), ইব্রাহিম খলিল (২০) এবং নাজমুল হাসান (২৮)। এদের মধ্যে আসিফ, শিশির এবং সাব্বির শনিবার আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লোমহর্ষক জবানবন্দি দিয়েছে।
এদিকে একমাত্র আয়ের উৎসের সন্ধান না পেয়ে দিশেহারা বাবুর পরিবারের সদস্যরা। ছেলে আবিদুর রহমান ইফাত নটর ডেম কলেজে পড়ে। তার প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা চলমান। আর মেয়ে মার্জয়া ভিকারুননিসা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। দুই সন্তানের পড়ালেখাসহ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় বাবুর স্ত্রী শারমিন জাহিদ। বাবুকে না পাওয়া গেলে তাদের সংসারই বা চলবে কীভাবে-তা নিয়ে শারমিন বিপাকে। নয় দিনেও বাবুর কোনো খোঁজ না মেলায় তাকে জীবিত পাওয়ার আশা অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
বাবুর স্ত্রী গৃহবধূ শারমিন জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বাবুকে জীবিত পাব কিনা জানি না। অন্তত তার লাশটা পেলেও সান্ত্বনা পেতাম। তিনি বলেন, গত শক্রবার থেকেই স্বামীকে পাচ্ছিলাম না। থানায় থানায় খুঁজেছি। মর্গে মর্গে গিয়েছি। কোথাও পাইনি। শুরুর দিকে অবস্থা এমন ছিল যে, থানায় যাওয়ার অবস্থা পর্যন্ত ছিল না।
বাধ্য হয়ে ডিবিতে গিয়েছি। ডিবির ডিসি সাহেদ আল মাসুদের কাছে যাওয়ার পর তিনি প্রযুক্তির সহায়তায় তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেন। পরে গত ২৫ জুলাই ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। জিডির তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে ঘটনা ঘটেছে কদমতলী থানা এলাকায়।
পরে শনিবার (২৭ জুলাই) কদমতলী থানায় একটি মামলা করা হয়। ডিবি পুলিশ এরই মধ্যে আমার স্বামীকে পেটানো এবং নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও পেয়েছে। আমার ভাগ্নে ওই ভিডিও দেখে এসেছে। এখনো আমরা বাবুকে খুঁজে যাচ্ছি। তিনি বলেন, পরিবারের প্রধান ব্যক্তিকে না পাওয়া গেলে কী অবস্থা হবে তা এই মুহূর্তে আমরা নির্মমভাবে উপলব্ধি করছি। আমার ছেলেমেয়েরা আর বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারবে না-এটা ভাবতেই পারছি না।’
বাবুর ছোট ভাই মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হাসান বলেন, ভাইয়ের সন্ধান পেতে জুরাইন, শনির আখড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সন্ধান চালাচ্ছি। কোথাও খোঁজ মিলছে না। আমরা খুব আপসেট অবস্থায় আছি। ভাইয়ের কাছে যদি লাইসেন্স করা অস্ত্রটি না থাকত তাহলে হয়তো এই পরিণতি হতো না। কারণ অস্ত্র দেখেই হামলাকারীরা তাকে পুলিশ সদস্য মনে করেছিল। এ কারণেই তাকে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হতে হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ শনিবার জানিয়েছেন, ১৯ জুলাই বাবু নিখোঁজের পর কোথাও সন্ধান না পেয়ে তার ভাই মঞ্জুরুল হাসান বাদী হয়ে ডেমরা থানায় একটি জিডি করেন। ডিসি সাহেদ আল মাসুদের তত্ত্বাবধানে এডিসি ইলিয়াস হোসেনের নেতৃত্বে ছায়াতদন্ত শুরু হয়।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা ও বিশ্বস্ত গুপ্তচরের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে শনাক্ত করি। পরে শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ভিকটিম বাবুর রিভলবার, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। বাবুর ছবি গ্রেফতারকৃতদের দেখানো হলে তারা শনাক্ত করেছে। পাশাপাশি ঘটনার মর্মান্তিক বর্ণনা দিয়েছে।