চট্টগ্রামে বুলেটবিদ্ধরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে
এম এ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামে বুলেটবিদ্ধরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে
নগরীর বহদ্দারহাটে প্রতিদিনের মতো ১৮ জুলাই ভ্যানে আম বিক্রি করছিলেন আবুল বাসার। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে তিনি কাগজ দিয়ে ভ্যানে থাকা আম মুড়িয়ে নেন। নিরাপদ দূরত্বে যেতে না যেতেই তিনি হাতে, শরীরে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সহায়-সম্বল হারিয়ে সেই থেকে তিনি হাসপাতালের বিছানাতেই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। আবুল বাসার ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনে চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও নয়জন। এদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ছাত্র, শিশুসহ শ্রমজীবী মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তাদের রোজগার যেমন বন্ধ রয়েছে, তেমনি চিকিৎসা খরচ মেটাতেও পরিবারের সদস্যদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে সহিংসতার ঘটনায় চাঁদপুরে অগ্নিদগ্ধ আবদুল মজিদ নামে এক কিশোর চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শুক্রবার হাসপাতালের আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ছয়জনে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার দুপুরে চমেক হাসপাতালের অর্থোসার্জারি ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ৪০ নম্বর বেডে শুয়ে আছেন গুলিবিদ্ধ আবুল বাসার। কথা বলতে পারছিলেন না, তার যন্ত্রণা কষ্ট যেন বের হয়ে আসছে চোখের পানি হয়ে। পাশে থাকা স্ত্রী খুকি বেগমের কোলে রয়েছে এক বছরের ছেলে রিফাত। স্বামীর যন্ত্রণায় কাঁদছিলেন স্ত্রীও। তিনি জানান, তার স্বামী একটি সমিতি থেকে ত্রিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আমের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। দুই সন্তান নিয়ে কোনোভাবে তাদের দিন যাচ্ছিল। কিন্তু আন্দোলনের দিন যে এভাবে সংঘর্ষ এবং গুলি হবে তা কল্পনাও করেননি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমসহ ভ্যান গাড়িটিরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে কী করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না।’
৩নং বেডে চিকিৎসাধীন ১৪ বছরের সুজনের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। সঙ্গে রয়েছে তার মা নুরুন্নাহার। তিনি বলেন, সুজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি মেসে কাজ করে। ১৮ জুলাই বাসায় ফেরার পথে বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সুজন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির পর আমরা জানতে পারি।
ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডের ১৩নং বেডে চিকিৎসাধীন নগরীর শুলকবহর দারুত তারবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ওসমান বলেন, ১৯ জুলাই মাগরিবের নামাজ পড়তে ঘর থেকে বের হয়ে আন্দোলনের মুখে পড়ে যাই। সংঘর্ষ শুরু হলে এলাকায় একটি গ্যারেজে আশ্রয় নেই। সেখানেও পুলিশ চলে আসায় পালানোর সময় তারা গুলি করে। আমি আন্দোলনে যোগ দেইনি। তাছাড়া আমি বড় জুব্বা গায়ে দিয়েছিলাম। আমাকে কেন গুলি করা হলো, আমি চিন্তা করে এখনো উত্তর পাইনি।
একই ওয়ার্ডের ৩০নং বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৫ বছরের আকাশ। পাশে ছিলেন বোন শারমিন আক্তার। দুই সন্তানের বাবা এনাম একজন গাড়ির মিস্ত্রি। পরিবার নিয়ে থাকেন নগরীর হামজারবাগ এলাকায়। তিনি বলেন, আকাশ এসি ওয়ারিংয়ের কাজ শিখছিল। ১৬ জুলাই দুপুরে ভাত খেয়ে কাজে যাওয়ার সময় শুলকবহর এলাকায় সে গুলিবিদ্ধ হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে তার দোকানের মালিক তাকে উদ্ধার হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর থেকে আমার মানিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডের ৯নং বেডে চিকিৎসাধীন রুবেল পেশায় রাজমিস্ত্রি। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে চান্দগাঁও এলাকায় ফিলিং স্টেশনের সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার মা হাজেরা বেগম বলেন, আমার স্বামীর বয়স হয়েছে, কিছু করতে করতে পারে না। ছেলের উপার্জনের ওপর আমরা নির্ভরশীল। তারও পরিবার রয়েছে। উপার্জন বন্ধ থাকায় আমাদের চলতে কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যেই ছেলের জন্য প্রতিদিন ওষুধের পেছনে ৮০০-১০০০ টাকা করে খরচ হচ্ছে।
তবে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, কোটা আন্দোলনে আহত রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যেসব ওষুধ হাসপাতালে নেই সেগুলো বাহির থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। চিকিৎসাধীন সবার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে রয়েছে। কোটা আন্দোলনে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইয়াস ও জিয়াউল হকসহ চমেক হাসপাতালের অর্থোসার্জারি ওয়ার্ডে পাঁচজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ফরিদ আহমেদ ঢাকায় আহত হয়েছেন। আহতরা ১৬ থেকে ১৯ জুলাই নগরীর বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁও এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে চক্ষু বিভাগে একজন ও ২৭নং সার্জারি ওয়ার্ডে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।