তদবির টেন্ডার নিয়োগ বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন জাহাঙ্গীর
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![তদবির টেন্ডার নিয়োগ বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন জাহাঙ্গীর](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/07/16/image-828524-1721082056.jpg)
ছবি সংগৃহীত
দেশজুড়ে আলোচনায় জাহাঙ্গীর আলম। দীর্ঘদিন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী। এই সময়ে তদবির, টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। নামে-বেনামে করেছেন একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন গাজীপুরে ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসা।
স্বপ্ন দেখেছিলেন সংসদ-সদস্য হওয়ার। বিপুল অর্থও খরচ করতেন নির্বাচনি এলাকায়। যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে গড়েছিলেন লাঠিয়াল বাহিনী। সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন লাইসেন্সকৃত পিস্তল। অবৈধ পথে অর্জিত টাকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভাই-ভাগনেসহ আত্মীয়-স্বজনদের।
জানা যায়, নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘পানি জাহাঙ্গীর’। তার বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল থানাধীন খিলপাড়া ইউনিয়নে। বাবা মৃত রহমত উল্লাহ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন ‘সুধা সদনের’ ব্যক্তিগত স্টাফ হিসাবে কাজ করেছেন। সে সময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেওয়া হতো, সেটা এই জাহাঙ্গীর বহন করতেন। এজন্যই তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ হিসাবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন।
জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসাবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তারপরও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জাহাঙ্গীরের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। বলা হয়, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্পর্ক নেই। তবুও তিনি ছিলেন আলোচনার বাইরে। এর মধ্যেই রোববার চীন সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা? জানতে পেরেছি, পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি। এরপর সারা দেশে আলোচনায় জাহাঙ্গীর আলম।
একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক, ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার : জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসাবে কাজ করলেও ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসাবে পরিচয় দিতেন সব জায়গায়। এই পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করতেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। দু-হাতে উপার্জন করতেন কোটি কোটি টাকা।
রাজধানী ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার। ঢাকার মিরপুরে একটি সাততলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে তার আটতলা একটি বাড়ি রয়েছে। সেটিও তার স্ত্রীর নামে। সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন লাইসেন্সকৃত পিস্তল। নিজ এলাকায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার।
এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভাই-ভাগনেদের : এলাকায় জমি দখল, দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর, লাঠিয়াল বাহিনী তৈরিসহ নানা অভিযোগ জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভাই, ভাগনে ও আত্মীয়-স্বজনদের। বড় ভাই মীর হোসেনকে করেছেন খিলপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি। ছোট ভাই আলমগীর হোসেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আরেক ভাই মনির হোসেনকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করেছেন। ভাগনে মাসুদুর রহমান শিপনকে করেছেন জেলা পরিষদের সদস্য। মূলত চাটখিলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতেন জাহাঙ্গীর।
এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন : অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ কামানোয় পিয়ন জাহাঙ্গীর নিজেও হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতিবিদ। ছিলেন চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। স্বপ্ন দেখতেন এমপি (সংসদ-সদস্য) হওয়ার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। বিপুল অর্থ খরচ করে দিয়েছিলেন শোডাউন। নৌকা না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। তবে পরবর্তীতে তার আর নির্বাচন করা হয়নি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষি খাত থেকে তার প্রতিবছর আয় দেখান ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আয়ের তথ্য দেখান।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা ছিল। ডিপিএস ছিল পৌনে তিন লাখ টাকা, এফিডিআর ছিল সোয়া এক কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ছয় কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংক হিসাব স্থগিত : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসাবে কাজ করা জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সঙ্গে তাদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত ব্যক্তি ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব থাকলে সেসব হিসাবের লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩ (১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলো।