তৃণমূলে ঐক্য ফেরাতে তৎপর আওয়ামী লীগ
সমস্যা চিহ্নিত করে ধারাবাহিক সফরের পরিকল্পনা
রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দলের তৃণমূলে ঐক্য ফেরাতে তৎপর হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময়ে দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট কোন্দল সমাধানে সাংগঠনিক সফর শুরু করছেন তারা। কর্মিসভা, বর্ধিতসভা, আলোচনা ও মতবিনিময় সভার মধ্যদিয়ে তৃণমূলকে বিভেদ ভুলে ঐক্যের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। দায়িত্বপ্রাপ্তারা বলছেন, সাংগঠনিক সফরের মধ্য দিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগ আরও সুসংগঠিত হবে। দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হবে। ওই মিটিংয়ে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাংগঠনিক সফর, মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলা সম্মেলন, দলের তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করাসহ বেশকিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। এরপরই দায়িত্বপ্রাপ্তরা তৃণমূলে আনুষ্ঠানিক সফর শুরু করবেন।
সর্বশেষ শনিবার বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ টিটু মিলনায়তনে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। তারা দুজনই রাজশাহী বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। আলোচনা সভায় ড. হাছান মাহমুদ বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দলে অনুপ্রবেশকারী ও সুবিধাবাদীরা প্রবেশ করেছে। এদের থেকে দলকে রক্ষা করতে হবে। আর এসএম কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা যাবে না। কেউ যদি দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে ২৮ জুন নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বিশেষ বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণ করেন কামাল হোসেন। দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন তিনি।
৪ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। স্থানীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ এবং সৃষ্ট দলীয় কোন্দলের লাগাম টানতে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেন তিনি। ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। মূলত তৃণমূল স্তরে নেতৃত্ব ঢেলে সাজানোর জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খুলনা বিভাগে ধারাবাহিক সফর করছেন আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক। ইতোমধ্যে যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল এবং মাগুরায় সফর শেষ করেছেন তিনি। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, কর্মিসভা ও আলোচনার মধ্যদিয়ে দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।
বিএম মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের তৃণমূলে কিছু সমস্যা আছে। এই সমস্যা সমাধান করতে বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান হবে এবং দলের ঐক্য ফিরবে।
নীলফামারী ও রংপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলায় সফর করেছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। সফরকালে বিশেষ বর্ধিত সভা, কর্মী সমাবেশ ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠক করেছেন। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দলে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান হবে বলে জানান তিনি।
সুজিত রায় নন্দী যুগান্তরকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ ছিল না। ফলে দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নির্বাচন কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও এই সমস্যাগুলো বেশি, সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং সমাধান করা হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, তৃণমূলের সমস্যা বিষয়ে খোঁজখবর ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি, সেগুলো দ্রুত সময়ে পূর্ণাঙ্গ করা হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটের সম্মেলন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। দলের ভেতরের সমস্যাগুলোও সমাধানের তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনো সমস্যা আছে কিনা? সেগুলো বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমস্যা পেলেই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দলীয় কোন্দলের কারণে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে টিকে থাকতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর চড়াও হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে রক্তারক্তি ছাড়াও খুনোখুনির মতো নির্মম ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন দলটির নেতাকর্মীরা। সংঘাত, সহিংসতা, হামলা-পালটা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে অনেক স্থানে। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যেসব এলাকায় কখনোই দ্বন্দ্ব ছিল না, সেখানকার নেতাকর্মীরাও হয়ে উঠছেন পরস্পরের চক্ষুশূল। অনেক স্থানে দলীয় এমপিরা (সংসদ-সদস্য) নিজেদের একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে বিরোধের আগুনে ঘি ঢেলেছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্ত্রী-সন্তান এবং আত্মীয়স্বজনের পক্ষে নির্বাচন করেছেন। ভোটের মাঠে সরব ভূমিকা রেখেছিলেন গত সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক এমপিরাও। তারাও দলের ভেতরে নিজেদের বলয় ধরে রাখার কৌশল নিয়েছিলেন।
সব মিলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দলীয় ঐক্য যে নষ্ট হয়েছে-তা দৃশ্যমান। এছাড়াও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোন্দল তো রয়েছেই। যদিও আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, তৃণমূলে গুছিয়ে নিতে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হবে। ওই মিটিং থেকে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হবে।