বাপেক্সের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষা
উত্তীর্ণদের বেশিরভাগই শীর্ষ কর্তাদের স্বজন!
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাপেক্সে মেধাবী প্রার্থীদের বাদ দিয়ে কৌশলে শীর্ষ কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাসনদ ছাড়াই অনেক ব্যক্তি নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত হয়েছেন। তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখন যাচাই-বাছাই পর্যায়ে আছে। এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেছেন সাতজন ভুক্তভোগী। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
রিট আবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার ফল ২ মে প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, যাদের নাম তালিকায় উঠেছে, তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের লোকজন। তাদের মধ্যে অনেকেই মোটা অঙ্কের ঘুস বা উৎকোচ দিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করেছেন। আর যারা সত্যিকারের অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন, তাদের নানা অজুহাতে বাদ দেওয়া হয়েছে।
রিটে জ্বালানি বিভাগের সচিব, পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান, বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন), ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন), জেনারেল ম্যানেজার (হিসাব) ও সালদা রিভার গ্যাস ফিল্ডের প্রকল্প পরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব যুগান্তরকে জানান, তার আমলে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো নিয়োগ হয়নি। আগের কয়েকটি নিয়োগের বিষয়ে হাইকোর্টের কিছু নির্দেশনা ছিল, সেগুলোরও বেশির ভাগ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে। নানা কারণে কিছু বাদ পড়েছেন, তারা আদালতে গেছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টে যে রিট হয়েছে, সেটি তিনি এখনো দেখেননি। তিনি বলেন, বর্তমানে যে নীতিমালা করা হয়েছে, তাতে কোনো অনভিজ্ঞ কর্মী বা কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ঢুকে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া এসব নিয়োগে একটি শক্তিশালী নিয়োগ কমিটি আছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ২/৩ জন বাদে বাকি সবাই মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলাসহ বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। কাজেই ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন বা অদক্ষ, অনভিজ্ঞ কেউ ঢুকে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
রিট মামলার কাগজপত্র (এনেক্সর-জে)-এর সঙ্গে দেওয়া একাধিক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত হওয়া প্রার্থীদের মধ্যে একজনের অভিজ্ঞতার সনদ ভুয়া। তিনি বাপেক্সের একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক এবং নিয়োগ কমিটির এক সদস্যের আত্মীয়। আলী নামের একজন প্রার্থী যিনি বাপেক্সের অনুমোদিত কোনো পদে কর্মরত ছিলেন না। রিগম্যানের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে গ্যাস ড্রিলিং রিগের কোনো ইনস্টিটিউট না থাকায় তার কোনো অভিজ্ঞতার সনদ থাকার কথা নয়। ওই প্রার্থীর বাবা বাপেক্সের এমপ্লোয়েজ ইউনিয়নের একজন শীর্ষ নেতা। তার নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য এবং প্রশাসন বিভাগের একজন মহাব্যবস্থাপক। আরেক প্রার্থী আছেন, যিনিও বাপেক্সের অনুমোদিত কোনো পদে কর্মরত ছিলেন না। তিনিও রিগম্যানের যে অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছেন, তা ভুয়া। তার জন্য সুপারিশকৃত কর্মকর্তা হলেন বাপেক্সের একজন ড্রিলিং ইনচার্জ। রিগম্যানের ভুয়া সনদ জমা দিয়ে আরেকজন প্রার্থীর নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে, যার জন্য সুপারিশ করেছেন নিয়োগ কমিটির সদস্য ও একজন প্রকল্প পরিচালক ও ডিলিং সুপারিনটেনডেন্ট। ওই প্রার্থী সুপারিশকৃত এই কর্মকর্তার আত্মীয়।
একই অভিযোগ তোফাজ্জল হোসেন নামে অপর এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তিনি একজন উপ-মহাব্যবস্থাপকের আত্মীয়। নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত হওয়া বাপেক্সের একজন অফিস সহকারীও রয়েছেন। তার অভিজ্ঞতার সনদটিও ভুয়া। এই অফিস সহকারীর জন্য সুপারিশ করেছেন একজন টুলপুশার কর্মকর্তা। বাপেক্সে কোনোদিন কাজ না করলেও এই অফিসে কাজ করার অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছেন একজন। তার জন্য সুপারিশ করেছেন একজন ডিলিং ইনচার্জ। বাপেক্সের সিমেন্টিং অপারেটর হিসাবে কর্মরত থাকলেও রিগম্যান হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে একজন চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তার জন্য সুপারিশ করেছেন বাপেক্সের একজন উপ-মহাব্যবস্থাপক। একইভাবে স্টোরকিপার হিসাবে চাকরি করে জমা দিয়েছেন রিগম্যানের সার্টিফিকেট ও অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ। ট্রেড কোর্স সনদ দিয়ে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তার জন্য সুপারিশ করেছেন বাপেক্সের একজন ড্রিলিং সুপারিনটেনডেন্ট। একই কায়দায় বাপেক্সের সিমেন্টিং অপারেটর হিসাবে কর্মরত থাকলেও রিগম্যানের ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
আরও জানা যায়, বাপেক্সের একজন ডিলিং সুপারিনটেনডেন্ট এই চূড়ান্ত হওয়া প্রার্থীর আপন ভাতিজা। রিট মামলায় এরকম আরও কমপক্ষে ১৫ জনের নাম আছে, যারা নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত হয়েছেন। জানা যায়, তারা সবাই বাপেক্সের কোনো না কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন।
এর আগেও বাপেক্সের অস্থায়ীভাবে ৮৫ জনসহ বিভিন্ন সময়ে পাঁচ শতাধিক লোকবল নিয়োগ দেওয়ার পর তাদের স্থায়ীকরণেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এসব ঘটনায় বিচার চেয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৩ জনকে নোটিশ (নোটিশ ডিমান্ডিং জাস্টিস) পাঠিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম সিদ্দিকুর রহমান খান। বাপেক্সের ১৭ কর্মীর পক্ষে গত বছর ২৮ নভেম্বর তিনি এ নোটিশ পাঠান। এরপর রিট দায়ের করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগকারীদের একজন যুগান্তরকে বলেন, বাপেক্সের ১৪২ জন কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তাদের রিপোর্টে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করলেও অদ্যাবধি কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার কারণেই অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সেসব কর্মকর্তা এখন বাপেক্সের বিভিন্ন শাখায় বড় ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে তোলার সুযোগ পায়। তারাই এখন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিচ্ছেন।
জানা যায়, ওই সময় বাপেক্সে ১৫টি পদে লোক নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এতে প্রায় ৭ হাজার আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু একটি চক্র কৌশলে ৫ হাজার আবেদনপত্র থেকে পোস্টাল অর্ডার গায়েব করে দেয় এবং ওইসব পোস্টাল অর্ডার ভাঙিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে। এ খবর ফাঁস হয়ে গেলে বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের পোষ্যদের চাকরি দেওয়ার জন্য পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া অথবা আবেদনপত্র জমা নেওয়ার সময় বাড়াতে লিখিত চিঠি দেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনা না করে ১ হাজার আবেদনকারীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করে। এরপর লিখিত পরীক্ষা শেষে ৩ মাসের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তড়িঘড়ি করে ১৪২ জনকে নিয়োপত্র দেয়। ওই নিয়োগে বাপেক্সের তৎকালীন নিয়োগ কমিটির এক সদস্যের ভাই চাকরি পান।
ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ ও ত্রুটিপূর্ণ আবেদন জমা দিয়ে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিকটাত্মীয়ও নিয়োগ পেয়েছিলেন ওই জোয়ারে। তিনি বর্তমানে বাপেক্সের হিসাব ও অর্থ শাখার সবচেয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এছাড়া তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পোষ্য কোটায় তার দুই আত্মীয়কে (ভাগিনা ও ভাগনি) নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনপত্র জমা দেওয়ার নির্ধারিত তারিখ পার হওয়ার ১ মাস ১৯ দিন পর আবেদন করে ভূতত্ত্ব কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়েছেন এক কর্মকর্তা।