Logo
Logo
×

শেষ পাতা

হাজার কোটি টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি

বান্দরবানে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ঠিকাদারি

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লাইসেন্স ব্যবহার করে বাঙালি ঠিকাদাররা ৭ শতাংশ কর ফাঁকি দিচ্ছেন * সিন্ডিকেটের বাইরে কাজ পান না সাধারণ ঠিকাদাররা

Icon

মোহাম্মদ ইলিয়াছ, বান্দরবান

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বান্দরবানে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ঠিকাদারি

প্রতীকী ছবি

বান্দরবানের ঠিকাদারি ব্যবসা গুটিকয়েক ঠিকাদারের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, প্রভাবিত করা ও ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের কাজে অনিয়ম তো আছেই। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। ঠিকাদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাধারণ ঠিকাদাররা মুখ খুললে তাদের বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া। এক কোটি, দুই কোটি বা শত কোটি টাকা নয়। বিগত দুই যুগ ধরে প্রায় হাজার কোটি টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে এ ঠিকাদার সিন্ডিকেট। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঠিকাদারদের লাইসেন্স ব্যবহার করেই এভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন তারা। ফলে একদিকে সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব, অপরদিকে ব্যাহত হচ্ছে সরকারের প্রকৃত উন্নয়ন উদ্দেশ্য। তিন পার্বত্য জেলায় পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঠিকাদারি ব্যবসায় ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখিয়েছে সরকার। পার্বত্য অঞ্চলে কোনো প্রকল্পের কাজ করলে সাধারণ ঠিকাদারদের যেখানে ১১ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়, সেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঠিকাদারদের দিতে হয় মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ তাদের জন্য ৭ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ। মুষ্টিমেয় কয়েকজন অসাধু ঠিকাদারের সিন্ডিকেট এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে। তারা নিজেদের ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার না করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লাইসেন্স ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইউটি মং, রতন সেন তঞ্চঙ্গ্যা, এমএস মারমা, অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা, এমএম ট্রেডার্স, মারমা এন্টারপ্রাইজ, ইমু কনস্ট্রাকশন, রিফ কনস্ট্রাকশন, মিল্টন ট্রেডার্স এবং মায়াধন চাকমা। এটি শুধু বান্দরবানে নয়, এ লাইসেন্সগুলো পার্বত্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে লাইসেন্সগুলো ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে।

সূত্রে জানা যায়, বিগত দুই যুগ ধরে বান্দরবানে প্রায় ১৫ হাজার ৩শ কোটি টাকার বিভিন্ন কাজ করা হয়েছে এই লাইসেন্সগুলোর নামে। যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে প্রায় ৩ হাজার ১শ কোটি, এলজিইডিতে প্রায় ৪ হাজার ৫শ কোটি, পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রায় ৩ হাজার ২শ কোটি, সড়ক ও জনপথে ৩ হাজার কোটি এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রায় ১ হাজার ৫শ কোটি টাকার কাজ করা হয়েছে। সেই হিসাবে ৭ শতাংশ হারে ১৫ হাজার ৩শ কোটি টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স হিসাবে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা।

বান্দরবান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. জিয়াউল ইসলাম বলেন, সরকার যদি ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে পাহাড়ি-বাঙালি সবার জন্য নিয়ম সমান করে দেয় তাহলে সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। তাহলে কেউ এভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারবে না।

আরেকটি বিষয় হলো-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লাইসেন্সগুলোর মালিকরা জানেন না কোথায় কোন কাজ হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে। তারা একটি কাজও নিজ হাতে করেননি। শুধু তাদের কাজগপত্রগুলো ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছে দিয়ে দেন। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর ১ বা ২ শতাংশ টাকা পান লাইসেন্সের মালিকরা। সূত্রে জানা গেছে, এই লাইসেন্সগুলোর মালিকরা এমনকি স্বাক্ষর করা ব্ল্যাঙ্ক চেক পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার অসংখ্য ঠিকাদারের কাছে জমা দিয়েছেন। যাতে তারা প্রকল্পের কাজ করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে নিতে পারেন।

কেন তারা কাজ না করে লাইসেন্সগুলো অন্যদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন-এমন প্রশ্নে লাইসেন্সধারী রতন সেন তঞ্চঙ্গ্যা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রতিবেদকের বিকাশ নাম্বার চান। লাইসেন্সধারী ইউটি মং মিটিংয়ের ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।

আরও একটি বিষয় হচ্ছে, বান্দরবানে শতাধিক লাইসেন্স থাকলেও শুধু সিন্ডিকেটের সদস্য ঠিকাদাররাই কাজ পান, বাকি ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হয় না। বিষয়টি নিয়ে বান্দরবানে ঠিকাদারদের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে। একজন সাধারণ ঠিকাদার বলেন, সিন্ডিকেটের বাইরে বান্দরবানে কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়িত।

বান্দরবানের কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, সরকার যেখানে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছে সেখানে বান্দরবানে ঠিকাদার সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। লাইসেন্সগুলো বাতিল করা উচিত অথবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম করা হলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম