বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
ফের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি
নতুন অর্থবছরে ১৯ খাতে ব্যয় কমবে ২১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা * ভূমি অধিগ্রহণ ও বিদেশভ্রমণে আসছে নিষেধাজ্ঞা * দীর্ঘ মেয়াদে ব্যয় হ্রাস প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা আছে -মাহবুব আহমেদ
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় নতুন অর্থবছরে ফের সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি আসছে। প্রকল্পের বরাদ্দ ঠিক রেখে অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। সব ধরনের ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ রাখা হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য শর্ত শিথিল করা হবে। একইভাবে বিধিনিষেধ থাকবে সরকারি সব ধরনের আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন নির্মাণেও। অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতে নতুন অর্থবছরে যে বরাদ্দ থাকছে, এর একটি অংশের ব্যয়ও স্থগিতের আওতায় আনা হবে। আর ডলার সংকটের কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। এসব বিষয় চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। প্রসঙ্গত, ২০২৩-২৪, ২০২২-২৩ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ে বিভিন্ন খাতে কৃচ্ছ্রসাধন ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো খাতে শর্তসাপেক্ষে তা শিথিল করা হয়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উদাসীন। এটি অর্থ বিভাগ পর্যবেক্ষণ করেছে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় এ সংকটের মধ্যেও রাস্তা নির্মাণ, নতুন ভবন নির্মাণ, স্থাপনা খাতে ব্যয় করার প্রবণতা থেকে বের হতে পারছে না। চলতি অর্থবছরে এসব খাতে অর্থব্যয়ের জন্য অর্থ বিভাগের অনুমোদনও চাচ্ছে। প্রকৃত অর্থে এ সময়ে খাদ্য, জ্বালানি ও সার আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ফলে এ উদাসীনতার কারণে এ মুহূর্তে জরুরি নয়-এমন ব্যয়গুলো স্থগিতের বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে।
কৃচ্ছ্রসাধন প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যয় কম করা হবে এবং শেষদিকে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ঢালাওভাবে নয়, অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন দরকার। না হলে দীর্ঘ মেয়াদে কৃচ্ছ্রসাধনে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রস্তাবিত বাজেটের (২০২৪-২৫) নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার কৃচ্ছ্র সাধনের আওতায় চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৯টি খাতের ব্যয় আগামী অর্থবছরে কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এ উদ্যোগের ফলে সাশ্রয় হবে সম্ভাব্য ২১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। তবে নতুন করে আরও কয়েকটি খাতে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি ঘোষণা করলে সাশ্রয়ের অঙ্ক আরও বাড়বে। চলতি অর্থবছরের ব্যয় ও বরাদ্দ স্থগিতের মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
অর্থ বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। এছাড়া আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা পুরোপুরি অর্জন নিয়ে সন্দিহান আছে। এজন্য বছরের শুরু থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটি পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তার মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরো বাজেটের আকারই ছোট করা হয়েছে। সরকার এখন মনে করছে, ঋণ করে খরচ করার চেয়ে কম ব্যয় ভালো। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করা ঠিক হবে না। কারণ, এতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা পড়বে। যেসব খাতে হ্রাস করলে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা হবে না, সে ব্যয় কাটছাঁট করা দরকার।
বিগত দুই বছরে করোনার অভিঘাত কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দেয় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতির ওপর। এরই মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠে ডলারের মূল্য, যা সর্বোচ্চ বেড়ে এখন ১১৭ টাকায় ঠেকেছে।
সূত্রমতে, নতুন করে বিদ্যুৎসহ বেশকিছু খাতে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা করছে অর্থ বিভাগ। তবে নতুন অর্থবছরে যেসব খাতে ইতোমধ্যে ব্যয় কমিয়ে বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-প্রশাসনিক ব্যয় ৪২৫ কোটি, বিভিন্ন প্রকার ফি ৪৬২ কোটি, কৃষিজ সরবরাহে ১২৬ কোটি এবং চিকিৎসা ও শল্য সরঞ্জাম ক্রয়ে ১৬২২ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে ব্যয় কম করা হবে জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪০১ কোটি, বিভিন্ন মুদ্রণকাজে ৩৯ কোটি এবং সাধারণ সরবরাহ ও কাঁচামাল সামগ্রী ক্রয়ে ২১৯ কোটি টাকা। বাজেট নথিপত্র বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সম্মানি খাতে ৭৮৮ কোটি, বিশেষ ব্যয় ১০ কোটি এবং ভর্তুকি খাতে ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা ব্যয় হ্রাস করা হয়। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে এ খাতে সুদ ব্যয় হ্রাস করা হয় ২ হাজার কোটি টাকা এবং সাশ্রয় করা হবে ট্রেজারি বন্ডের সুদ ব্যয় ১৬০০ কোটি টাকা।
এছাড়া চাষকৃত জৈবসম্পদ খাতে ২০২ কোটি, কম্পিউটার ডেটাবেজ খাতে ৩৪ কোটি, উইপন সিস্টেম খাতে ২৫৪ কোটি, মূল্যবান দ্রব্যাধিতে ৬ কোটি টাকা এবং ভূমি খাতে ব্যয় কমানো হয় ৪ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী যুগান্তরকে জানান, ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানোসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন প্রভাব পড়েনি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করলে উন্নত বিশ্বে মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে সরকার অর্থব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করছে। যেগুলো অপ্রয়োজনীয় ও বাতিল করা যেতে পারে, এ ধরনের ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। ব্যয় কমলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে সাপোর্ট করবে। তবে ঢালাওভাবে না করে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক ব্যয় আছে। সেগুলোয় কৃচ্ছ্রসাধন করা গেলে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না।
সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ৮ হাজার ৯০৬ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা আছে। এ খাতে বরাদ্দ স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া আবাসিক ও অনাবাসিক স্থাপনায় বরাদ্দ আছে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন, অন্যান্য ভবন এবং স্থাপনা খাত থেকে অর্থব্যয় স্থগিত হলে এ অর্থ সাশ্রয় হবে। এছাড়া যানবাহন কেনা বাবদ ৬ হাজার ৯৬৪ কোটি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জ্বালানি তেল কেনা বাবদ ৩ হাজার ৩৩৩ কোটি এবং বিদেশ ভ্রমণ খাতে ২ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা রাখা আছে। এদিকে সরকারি খরচে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুব জরুরি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত আছে। চলমান বিশ্ব অর্থনীতি ও দেশের ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর পরিকল্পনার আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা আগামী অর্থবছরেও থাকতে পারে।