Logo
Logo
×

শেষ পাতা

এমটিএফইর প্রতারণা

যোগসূত্র মিলছে না ১১ হাজার কোটি টাকা পাচারের

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তরের তথ্য পাওয়া যায়নি * পুলিশের ধারণা হুন্ডিতে পাচার হয়েছে

Icon

আসাদুল্লা লায়ন

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যোগসূত্র মিলছে না ১১ হাজার কোটি টাকা পাচারের

মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জের (এমটিএফই) মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে হাতিয়ে নেওয়া ১১ হাজার কোটি টাকা পাচারের যোগসূত্র মিলছে না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভুক্তভোগীর করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তারা হাতিয়ে নেওয়া অর্থের গন্তব্য খুঁজে পাননি এখনো। তদন্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনের তথ্য মেলেনি। এছাড়াও এসব মামলায় গ্রেফতার এমটিএফইর সিইওদের কাছ থেকেও উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাননি তারা। অন্যদিকে বিদেশে পলাতক মূল অভিযুক্তদের দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় এগোতে পারেনি পুলিশ। ফলে বড় এ প্রতারণার ঘটনায় আত্মসাৎ হওয়া টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে আনুমানিক ১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গায়েব হয় এমটিএফই নামের ভার্চুয়াল এই প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিলেন। এই ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের। দুবাইভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত মালটিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করত। এর প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আল ইসলাম বিদেশে পলাতক রয়েছেন।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমটিএফইর প্রতারণার ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। ভুক্তভোগীরা সিইওদের মাধ্যমে টাকা দিয়েছেন। পরে এমটিএফইর সাইটে ওই টাকায় নির্দিষ্ট পয়েন্ট দেখানো হয়েছে। সিইওরা এসব টাকা মাসুদ আল ইসলামের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত যেসব সিইওদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে টাকা মাসুদের কাছে যাওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর টাকা সিইওরা নিয়েছেন সেগুলোর তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়াও তারা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের কথা বলে টাকা নিয়েছেন তবে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ বা লেনদেনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ আল জাবের যুগান্তরকে বলেন, তারা মূলত প্রতারণার জন্যই এই ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরি করেছিলেন। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে বিনিয়োগের নামে টাকা নিয়ে ওই সাইটে পয়েন্ট দেখাত, দ্রুত বিভিন্ন অঙ্কে লাভ যোগ করত। এতে প্রলুব্ধ হয়ে বহু মানুষ তাদের টাকা চক্রের সদস্যদের হাতে তুলে দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

দ্রুত অধিক লাভের ফাঁদে পড়ে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার মো. মারুফ রহমান মাহিম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে পলাতক এমটিএফইর অ্যাম্বাসেডর মুবাশসিরুল ইবাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে পরিচয় ছিল। তার মাধ্যমে এমটিএফইতে আমি ও পরিবারের সদস্যরা প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হই। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় গত বছরের আগস্টে মামলা করি। এরপর মামলাটির তদন্ত সিআইডিতে যায়। তবে এখনো টাকা উদ্ধার ও অভিযুক্তদের গ্রেফতারের বিষয়ে কিছু জানায়নি তারা।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক লালবুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এই মামলাটির সূত্র ধরে এমটিএফইর এই প্রতারণার বিষয়ে আমরা বিস্তর কাজ করছি। তদন্তে আমরা এমটিএফইর অনেক সিইওর নাম পেয়েছি। তাদের মধ্যে ৬ জনের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করছি। প্রাথমিকভাবে প্রতারণার বিষয়ে প্রমাণ পেলে তাদের গ্রেফতার করা হবে। এছাড়া বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়েও আমরা সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বড় এই আর্থিক প্রতারণার ঘটনায় অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো পাইনি আমরা।

এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়টি সামনে এলে ভুক্তভোগীদের তথ্য চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় সিআইডি। এরপর ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কাছে ৬ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন বলে জানান সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) পরিদর্শক। তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় অধিকাংশ ভুক্তভোগী টাকা উদ্ধারের দাবি জানালেও আইনগত প্রক্রিয়ায় আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ।

এদিকে ১৭ এপ্রিল রেজা ওরফে মহসীন রেজা নামের এক ব্যক্তিকে ২ দিনের রিমান্ডে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। এর আগে রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ বিষয়ে সিটিটিসির ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মো. ছায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এই মামলায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা মূলত মানুষকে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্কে টাকা পেতেন। ভুক্তভোগীদের টাকা তারা বিদেশে অবস্থানরত মাসুদের কাছে পাঠাতেন বিভিন্নভাবে। তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এখনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এই মামলার তদন্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া হাতিয়ে নেওয়া অর্থের গন্তব্য খুঁজতে ভুক্তভোগীরা সিইওদের মাধ্যমে যেসব এমএফএস ও ব্যাংক হিসাবে টাকা দিয়েছেন সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বড় অঙ্কের এই টাকা হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়েছে।

এমটিএফইর প্রতারণার ঘটনায় গত বছরের ২৩ জুলাই রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করা হয়। রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) যৌথ দল গঠন করে তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। পরে এ ঘটনায় তারা তদন্তে নেমে ৫ জনকে গ্রেফতার করেন।

তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে রাজশাহীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক যুগান্তরকে বলেন, নিজেরাই এখানে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা দাবি করেছেন। তারা এমটিএফইতে বিনিয়োগের নামে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে আনুমানিক ২ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে জেনেছি। তবে এই টাকা কাকে কীভাবে দিয়েছেন তা বিস্তর তদন্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য চেয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। এখনো তাদের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য আমরা পাইনি।

এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ভুক্তভোগী মামলা করেছেন। তবে বড় অঙ্কের এই টাকা এমটিএফইর সিইও বা এজেন্টদের মাধ্যমে কীভাবে পাচার হয়েছে তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। এভাবে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত করে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এমটিএফইর মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য পাননি তারা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম