ডিএনসিসির অবকাঠামো উন্নয়ন-সংস্কারকাজ
তদারকিতে নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রকৌশলী-ঠিকাদার
কাজের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত, খরচ বাড়ার শঙ্কা ঠিকাদারদের * অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ এবং সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পন্ন করতেই এ উদ্যোগ -সিইও, ডিএনসিসি
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রকৌশলগত কাজের তদারকিতে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে যুক্ত করা হয়েছে। এ পদে সরকারের উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। সম্প্রতি সংস্থার এক অফিস আদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সংস্কারকাজে তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অকারিগরি তদারককে এমন ক্ষমতা দেওয়া প্রকারান্তে প্রকৌশলগত কাজে এক ধরনের বাধা সৃষ্টির শামিল বলে মনে করছেন প্রকৌশলীরা।
তাদের মতে, পদমর্যাদায় এ কর্মকর্তা সংস্থার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্য প্রকৌশলীদের ওপরে হওয়ায় এখানে প্রকৌশলীদের মতামত মুখ্য থাকবে না। পাশাপাশি রাজধানীতে প্রকৌশলগত কাজগুলো সাধারণত রাতে করা হয়ে থাকে। ওই সময় উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকা বা পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। এজন্য কাজ বাস্তবায়নে এটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন তারা। আর ঠিকাদাররা বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশল কাজের তদারকির দায়িত্ব মাঠপর্যায় থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত প্রকৌশলীরা করে চলেছেন।
সবার কারিগরি জ্ঞান থাকায় কাজ বাস্তবায়ন বা কোনো জটিল বিষয় সামনে এলে সহজে সমাধান করা যায়। অকারিগরি লোককে সেগুলো বোঝানো দুষ্কর হবে। এছাড়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের কমিশন না দিয়ে ঠিকাদাররা কাজ করতে পারেন না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন অকারিগরি কর্মকর্তাকে প্রকৌশলগত কাজের তদারকের দায়িত্ব দেওয়ায় একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমবে, অন্যদিকে ঠিকাদারদের প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ বাড়বে।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর খায়রুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা কারিগরি লোক নন, এটা সত্য। তবে তারা যে কাজ করবেন, সেটা পুরোপুরি কারিগরি লোক না হলেও করা যাবে। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজগুলো হচ্ছে কি না, তারা তা তদারকি করবে।
মাঠপর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালনের সময় তো তারা এ কাজগুলো করেছেন। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের তদারকিতে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হয়েছে অল্প কিছুদিন হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি, দেখা যাক কী হয়। তাছাড়া একটা বিষয় বুঝতে হবে যে কারিগরি কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা রকেট সায়েন্সও নয় যে, বোঝা যাবে না। বরং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ হবে এবং সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২৯ মে এক অফিস আদেশে বলা হয়, সংস্থার আওতাধীন বিভিন্ন ভবন, ব্রিজ ও সড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন-রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কার ও মেরামতের প্রত্যেক পর্যায়ে রড ও ঢালাইয়ের মান, পুরুত্ব, ঘনত্ব কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এ কাজ করার সময় আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। ফটোগ্রাফ বিলের সঙ্গে পাঠাতে হবে।
আরও জানা যায়, ৩০ মে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাসহ এক দাপ্তরিক আদেশ জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২৯ মে অফিস আদেশ অনুসরণ করে এ সংক্রান্ত কাজের তদারকি করতে একটি ছক তৈরি করা হলো। সংশ্লিষ্টদের ছক অনুসরণ করে পরিদর্শন বা অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের তদারকি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
ওই চিঠির ছকে উল্লেখ করা হয়েছে, কাজের নাম ও টেন্ডর আইডি, চুক্তিমূল্য, কাজ শুরুর সময় ও সমাপ্তির তারিখ, ঠিকাদারের নাম ও ঠিকানা, পরিদর্শনের তারিখ ও ছবি, পরিদর্শন প্রতিবেদন, মন্তব্য ও স্বাক্ষর। ছকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজটি পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, প্রতিটি পর্যায়ে রড ও ঢালাইয়ের মান, পুরুত্ব, ঘনত্ব স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বাস্তবায়ন হচ্ছে/হচ্ছে না; এমন কলামে টিকচিহ্ন দিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়, পরিদর্শন প্রতিবেদনে উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকবে। আগে নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষরের পর ওই ফাইল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশল হয়ে ফাইল নিষ্পত্তি হতো। বাকি ধাপে সচিব, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সবশেষ মেয়র ফাইলের চূড়ান্ত অনুমোদন দিতেন। নতুন করে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে যুক্ত করার কারণে ওই প্রতিবেদনগুলোর কোনো যাচাই-বাছাই করা উপরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের জন্য বিব্রতকর। কেননা আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা পদমর্যাদায় তাদের চেয়ে ওপরে।
ঢাকা উত্তর সিটির একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী জানান, মেয়রের বর্তমান ব্যক্তিগত সহকারী-পিএস বেশকিছু ফাইলের কাজ ও বিল পরিশোধ করার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি সেসব ফাইল মেয়রকে দিয়ে ফেরত পাঠান। সেসময় প্রকৌশলীদের কয়েকজন তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। প্রকৌশলীদের মতে, ফাইল ফেরত পাঠানো সঠিক হয়নি। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে ফাইলের প্রস্তাব করা হয়। এরপরও তিনি মেয়রকে ভুল বুঝিয়ে এটা করেছেন। তাছাড়া প্রকৌশলীদের সম্পর্কে আপত্তিজনক মন্তব্যও করেছেন। তাৎক্ষণিক প্রকৌশলীরা বিষয়টি সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, মেয়রের পিএস প্রকৌশলীদের বলেছেন, তারা ঠিকাদারকে এক কাজের বিল দুবার পরিশোধ করেছে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুস নেন। এমন নানা ধরনের অসম্মানজনক কথা বলেছেন। মাঠ পর্যায়ের অনেক কাজে ঠিকাদাররা ভুলও করেন, অনেক ক্ষেত্রে সেসব দায় প্রকৌশলীদের ওপর পড়ে। পাশাপাশি অসাধু লোক তো সব জায়গায় রয়েছে। মূলত সন্দেহ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রকৌশল কাজের তদারকে যুক্ত করা হয়েছে। এখান থেকে ভালো কিছু আসবে বলে মনে হয় না। কারণ, বেশির ভাগ কর্মকর্তা প্রকৌশল কাজের ফাইল থেকে কমিশন নিয়ে থাকেন। আঞ্চলিক কর্মকর্তারা সেই চর্চা করলে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। পাশাপাশি কাজ বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়ে যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মেয়রের পিএসের কোনো আদেশ জারি করার ক্ষমতা নেই। তবে আইনগত বিষয়গুলো মেয়রকে অবহিত করা পিএসের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের ভুলত্রুটি বা অনিয়ম হয় না, এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। মাঠপর্যায়ের কাজগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখান থেকে ভালো কিছু আসবে মনে করে করেছেন, দেখা যাক কী হয়। ভালো না হলে কর্তৃপক্ষের তা বাতিল করারও ক্ষমতা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রকৌশলী বা অন্যান্য পদে যারা রয়েছেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এখানে কাজের প্রয়োজনে আমরা আলাপ-আলোচনা করে থাকি। জনসেবা ও উন্নয়ন কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে ব্যক্তিগত কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। কারও বুঝতে ভুল হতে পারে।