এমপি আনার হত্যাকাণ্ড
মরদেহ ছাড়াও আসন শূন্য ঘোষণা সম্ভব
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের সদস্য পদ শূন্য ঘোষণার প্রক্রিয়া নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত আনারের মরদেহ পাওয়া না গেলেও তার সংসদ-সদস্য পদ শূণ্য ঘোষণায় কোনো বাধা নেই। তবে এক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে ভারত ও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত করলেও তার মরদেহ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনারকে। তাকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয় । ২২ মে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই হত্যাকাণ্ডের কথা গণমাধ্যমকে জানান। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আলাদাভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মরদেহ না মেলায় আনোয়ারুল আজিমের মৃত্যু সনদ দেবেন কে বা কোন কর্তৃপক্ষ, আর তার সংসদীয় আসনই বা শূন্য ঘোষণা করা হবে কীভাবে-এ ধরনের নানা প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে।
আনারের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এর আগে যুগান্তরসহ একাধিক গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, আমরা এখনই এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না, আরও অপেক্ষা করব। কারণ এ ঘটনা খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। আমাদের সামনে এমন ঘটনার কোনো নজির নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
তিনি আরও বলেন, এর আগে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মরদেহ পাওয়া নিয়ে কোনো জটিলতা হয়নি এবং জানাজা হয়েছে। সেই হিসাবে তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে না জানালেও সংসদ নিশ্চিত হয়েছিল যে তারা মারা গেছেন। কাজেই সেসব ঘটনার সঙ্গে এটিকে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। এখানে সমস্যা হচ্ছে, তার দেহটি পাওয়া যায়নি। উনার মৃত্যুসনদ বা কোনো কাগজ আমাদের কাছে আসতে হবে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এমন একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ফলে এ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা, আলোচনা চলছে। ৫ জুন সংসদ অধিবেশনের আগে কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হবে, সেখানে আলোচনা হবে। ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন। বাজেট অধিবেশন শুরুর আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে বলে আশা করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংবিধানের ৬৭ ধারার ১(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে সংসদের অনুমতি না নিয়ে একজন সংসদ-সদস্য এক নাগাড়ে ৯০ কার্যদিবস জাতীয় সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এরপর এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
মরহেদ না মিললে কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টি সমাধান হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, নিহত সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের খুনের ঘটনা যারা তদন্ত করছেন, তারা যদি মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন সংসদ সচিবালয়কে জানাবে। সংসদ সচিবালয় তার আসন শূন্য ঘোষণা করে তা নির্বাচন কমিশনকে জানাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্ষীয়ান আইনজীবী ও সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন। এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেনি। আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ না পাওয়া গেলেও রক্তসহ কিছু তথ্য-উপাত্ত মিলেছে। এগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়া যাবে, ডিএনএ টেস্টও করা হবে-এসবের আলোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যারা তদন্ত করছে, তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার পর একটি সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তবে অবশ্যই এ বিষয়ে আইনি মতামত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, মরদেহ পাওয়া না গেলেও সরকারের তরফ থেকে মৃত্যু নিশ্চিত করা হলে সংসদ সচিবালয় আনোয়ারুল আজিম আনারের আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারে, এতে কোনো বাধা নেই।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি যারা তদন্ত করছেন তারা যদি নিশ্চিত হন আনোয়ারুল আজিম আনার মারা গেছেন, তাহলে তারা আদালতে প্রতিবেদন দেবেন। আদালত যদি এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত দেন যে ওই সংসদ-সদস্য আর বেঁচে নেই, তাহলে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর ভর করেই সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য করতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু আনোয়ারুল আজিম আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে শোকবার্তা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন, তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটিও গুরুত্ব পেতে পারে। এরসঙ্গে তদন্তকারী সংস্থার প্রতিবেদন যুক্ত হলে বিষয়টি সুরাহা আরও সহজ হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টির সুরাহা করতে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার পরামর্শ গ্রহণ করবেন। এছাড়াও তিনি সংসদ সচিবালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে সমাধান করবেন।
আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ পাওয়া না গেলেও ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইট থেকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা গেছে, ঝিনাইদহে চারটি সংসদীয় আসন থাকলেও সেখানে তিনটি আসনের (ঝিনাইদহ-১, ঝিনাইদহ-২ ও ঝিনাইদহ-৩) তথ্য রয়েছে। ঝিনাইদহ-৪ আসন এবং ওই আসনের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নাম দেখা যায়নি। ৫ জুন বিকাল ৫টায় দ্বাদশ সংসদের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হবে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এতে সভাপতিত্ব করবেন। এর আগে বিকাল ৪টায় জাতীয় সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হবে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ওই বৈঠকেও সভাপতিত্ব করবেন। সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, বিষয়টি ওই দিনই স্পষ্ট হওয়া যাবে।
১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান আনোয়ারুল আজিম আনার। ১৩ মে বন্ধু গোপালের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। পরে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর লাগোয়া নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন এমপি আনার। খুনের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিনই রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়েছে।