বনাঞ্চল ধ্বংসে নানা অজুহাত
বন উজাড়ে জড়িত বন কর্মকর্তারাই
শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে * উজাড় হওয়া বনভূমি উদ্ধারে সরকার কঠোর : প্রধান বন সংরক্ষক * সামাজিক বনায়নের টাকা কারা খেয়েছে তদন্ত দরকার : ইকবাল হাবিব
আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাবিতে বন উজাড়ের প্রতিবাদে গাছের প্রতীকী লাশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ফাইল ছবি
বিভিন্ন অজুহাতে দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও ধ্বংস করা হচ্ছে বন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশে যেখানে ২৫ শতাংশ বন থাকার কথা, সেখানে রয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বন ও পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, বাস্তবে দেশে এ পরিমাণ বনও নেই। বনের শত্রু বনজসম্পদ রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। তারা ব্যক্তিস্বার্থে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয় বনাঞ্চল। বন উজাড়ে জড়িত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এরই মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রতি বছর কয়েক কোটি গাছের চারা রোপণ করে। এতে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ শতাংশ গাছের চারাও টেকে না। ২০২২-২০২৩ অর্থবছর দেশে ৭ কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার ৬০০টি গাছের চারা লাগানো হয়। চলতি অর্থবছর লাগানো হবে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৮০টি গাছের চারা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নতুন গাছের চারা গরু ছাগলে খেয়ে ফেলে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক বছরে শুধু কক্সবাজারে ২৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের হাতে ১০ শতাংশ, বাকি ৯০ শতাংশ উজাড় হয়েছে স্থানীয়দের মাধ্যমে। বন বিভাগের নামে সংরক্ষিত বন থাকলেও তা রক্ষার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের। সে ক্ষেত্রে বন ও বনজসম্পদ রক্ষায় জেলা প্রশাসকরাও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বনের জমিতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, বনের আশপাশের জমি সরকারি ও বেসরকারি শিল্প-কারখানা এবং স্থাপনা তৈরিতে বরাদ্দ প্রদান, বনকেন্দ্রিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও বনের জমি জবরদখলের মাধ্যমে বন ধ্বংসের বহুমুখী কর্মযজ্ঞ চলছে। ফলে বনজসম্পদ ও বনভূমি রক্ষায় নিয়োজিতরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বন আইনের বিধিমালার অনুপস্থিতি এবং ৯৪ বছরের পুরোনো আইনে বন, বনভূমি এবং বনজসম্পদ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে রয়েছে বন অধিদপ্তরের সদিচ্ছার ঘাটতিও। বন আইন-২০২৩ এর খসড়া প্রণয়ন করা হলেও বিশেষজ্ঞরা নতুন আইনকে ১৯২৭ সালের বন আইনের পুনর্মুদ্রণ বলে অভিহিত করেছেন। প্রস্তাবিত আইনের ২৮ ধারার বিধানবলে যথেচ্ছভাবে সংরক্ষিত বনের জমি সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। ২৬, ৭৩ ও ৮০ ধারায় বন কর্মকর্তাকে অপরাধ আপস করার ক্ষমতা প্রদান এবং সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্যাদি সম্পাদনে দায়মুক্তির বিধান, অবৈধ দখলদারিত্ব ও স্থাপনা উচ্ছেদে বন অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত ক্ষমতা না দেওয়ায় আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিয়েও সংশয় রয়েছে।
জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, উজাড় হওয়া বনভূমি উদ্ধারে সরকার বেশ কঠোর অবস্থানে। ২০২০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার একর বনভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। জবরদখলে থাকা বন ও ভূমি উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। উদ্ধার করা জমিতে বনায়ন করা হয়েছে। বনের কর্মচারীরা জবরদখলে সহায়তা করে। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে বনভূমি উজাড় হচ্ছে-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, সরকারি চাকরিতে সবাই খারাপ আবার সবাই ভালো তা কিন্তু নয়। যারা অপরাধ করে তাদের শাস্তি হয়। ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আবার বন রক্ষায় জীবন দেওয়ার মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান বন সংরক্ষক জানান, প্রতি বছর আমরা যে পরিমাণ গাছের চারা রোপণ করি তার ৬০ শতাংশ বাঁচে। হিটওয়েব, সংরক্ষণ, পরিচর্যার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে গাছের চারা মরে যায়। আবার সংরক্ষিত বনের ৮০ শতাংশ গাছের চারা বাঁচে। বনের জমি রক্ষায় ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ বনভূমি সুরক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে। মালয়েশিয়ায় প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও বনাঞ্চলের পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এ হার ৬৭ দশমিক ৬ ও জাপানে ৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশে মাত্র ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার কারণে বন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে, এখনই সময় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস রোধে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রাণ ও প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবং তার বাস্তবায়নে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, যক্ষের ধন বনভূমি সংরক্ষণে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অবহেলা-অবজ্ঞার কোনো শেষ নেই। জবাবদিহিতার অভাবে রক্ষকরাই এখন ভক্ষক। অর্থলিপ্সু কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে বনের গাছ কাটা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। যারা সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের খুনও করা হচ্ছে। পুরো বন সেক্টরে এক ধরনের অসুস্থতা বিরাজমান। নেই পর্যাপ্ত বনসম্পদ রক্ষার মতো জনবলও।
বন ধ্বংসে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে উল্লেখ করে ইবাল হাবিব বলেন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফওএ) রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বনভূমি উজাড় হচ্ছে। এটা বিশ্বের কোথাও নেই। ঢাকা শহর গাছ ও বনশূন্য। ফলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দেশের অন্যান্য শহরও দিনে দিনে গাছশূন্য, বনশূন্য হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের টাকা কারা খেয়েছে তদন্ত হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।