Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা বৈঠক

সংকট কাটাতে চার নির্দেশ

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকট কাটাতে চার নির্দেশ

সংকট থেকে দেশের অর্থনীতিকে বের করতে চার দফা নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর মধ্যে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অ-অর্থনৈতিক (বাজার মনিটরিং ও খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি) কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দাতাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে স্বল্প সুদে বিদেশি ঋণ সংগ্রহের বিষয়ে। এছাড়া রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক বৈঠকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।’ তিনি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে মুদ্রা বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আহরণ ও প্রবাস আয় সম্পর্কে জানতে চান ।

এই সময়ে নমনীয় (স্বল্প সুদে) ঋণ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক অর্থ সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, নমনীয় ঋণ সংগ্রহ করতে পারলে ভালো। কিন্তু ধীরে ধীর ক্ষীণ হচ্ছে নমনীয় ঋণ পাওয়ার বিষয়টি। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর দাতা সংস্থাগুলো এ ধরনের ঋণ দেবে না। এই ঋণ পাওয়ার একটি লিমিট আছে। এর বাইরে ভবিষ্যতে আর বেশি পাওয়া যাবে না। সে অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে। যদিও বেশিরভাগ ঋণ এখন আমাদের নমনীয়।

বৈঠকে অর্থনীতির নানা সূচকের অবস্থান তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি ও এলসি খোলার হার কমছে বলে তথ্য উত্থাপন করা হয়। এছাড়া গত অর্থবছরে যেখানে এলসি খোলা হয়েছে ৯৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের। সেখানে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত এলসি খোলা হয় ৬৯০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২৬০০ কোটি ডলারের এলসি কম খোলা হয়েছে বলে জানানো হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ ও ফেরত আসা প্রবাসীদের পরিসংখ্যান না থাকার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। পণ্যের মূল্য কারসাজি রোধে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের লেন্ডিং কস্ট (প্রকৃত আমদানি মূল্য) এবং বাজারে বিক্রয় মূল্যে পার্থক্য কত দাঁড়াচ্ছে তা খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়। এছাড়া ঢাকা শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনের কারণে মূসক বাড়ছে বলে জানানো হয়।

সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতির তেজিভাব, ডলারের সংকট, রাজস্ব আয়ে শ্লথগতির ঝাকুনি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে নতজানু হয়ে পড়ছে অর্থনীতি। এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে আশার আলো দেখানোর চেষ্টা করছেন নতুন অর্থমন্ত্রী। সেটি করতে গিয়ে অর্থনীতির সংকটের গভীরতা খতিয়ে দেখতে এ সংক্রান্ত বৈঠক করেছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব।

বৈঠকে মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, অর্থনৈতিক এবং অ-অর্থনৈতিক দুটি বিষয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। অর্থনৈতিক হলো নীতি সুদ হার। ইতোমধ্যে এ সুদ হার বাড়ানো হয়েছে। অ-অর্থনৈতিক হলো বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা। কার্যকরভাবে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এনবিআরের উদ্যোগ ও বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। গভর্নর আরও বলেন, ‘বিগত ৭ মাসে প্রবাস আয় সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জানুয়ারিতে ২.১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ‘বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ছে। তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার এলসি খোলা হয়েছে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলারের হোল্ডিং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বৈঠকে জানান, জানুয়ারিতে বাড়ি ভাড়া, শীতকালীন পোশাক ক্রয়, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় এবং শিক্ষার্থীদের নতুন শ্রেণিতে উঠার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমা সত্ত্বেও ভোক্তা মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার উপরে আছে। ২০২৩-২৪ সালে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা সংক্রান্ত বৈঠকে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, অবৈধ মজুদদার, ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিষয় স্থান পায়। সেখানে বলা হয়, অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এনবিআর পণ্যের আমদানি শুল্ক-কর হ্রাসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ইতোমধ্যে নিত্যপণ্যের মূল্য কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আলোচনা শেষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে যৌথভাবে পণ্য মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার তদারকি করতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়ে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা গত পাঁচ বছরে ১০ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়েছে। প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ঘাটতি পূরণ হয়নি। প্রথমে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানোর পরও এই আট মাসে এনবিআর এখন ১৮ হাজার ২২১ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেখানে রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে। আশার কথা হচ্ছে, এ বছর পাঁচ লাখ আয়কর রিটার্ন বেড়েছে। আরও তিন লাখ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, মূসকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। এটা মূলত ঢাকা শহরে ইলেকট্রিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনের কারণে সম্ভব হয়েছে। ওই বৈঠকে রাজস্ব আহরণ প্রসঙ্গে বলা হয়, আইএমএফ ঋণের বিপরীতে রাজস্ব আহরণের শর্ত দিয়েছে। ওই শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ আদায়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

অর্থনীতিতে বড় চাপ সৃষ্টি করেছে বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ। বৈঠকে জানানো হয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৬২৪০ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঋণের প্রতিশ্রুতি ছিল ৯৯০ কোটি মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে ছাড় হয়েছে ৬৫০ কোটি ডলার। সেখানে আরও বলা হয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০০ থেকে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এই প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অর্থ ছাড় হয়েছে ৪০৬ কোটি ডলার। এটি অর্থবছর শেষে ৯০০ কোটি ডলারে পৌঁছবে। ঋণ পরিশোধ প্রসঙ্গে সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, ‘রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণ এবং মেগা প্রকল্পের বৃহৎ ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকায় ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলেও ২০৩৪ সালের পর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ঋণ ফেরত প্রদানে ব্যর্থ হয়নি সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫৯ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিশোধের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৬ কোটি ডলারে এবং চলতি অর্থবছরে তা ৫৩৬ কোটি ডলারে পৌঁছবে। ওই বৈঠকে নমনীয় (স্বল্প সুদে) ঋণ সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এজন্য দাতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

বিদেশি ঋণ পরিশোধে প্রবাসী আয় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয় ওই সভায়। সেখানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব মো. রুহুল আমিন বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে ২৮ শতাংশ অর্থাৎ এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। কিন্তু এর মধ্যে ফেরত আসা কর্মীর পরিসংখ্যান রাখা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কর্মী প্রেরণের প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভাষা। মূলত আরবি, কোরিয়ান, ইংরেজি, জাপানিজ ও চাইনিজ ভাষার ওপর দখল থাকা জরুরি। সেখানে প্রবাসী আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে দক্ষ কর্মী তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। এজন্য যৌথভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, মার্চের প্রথম ২২ দিনে ব্যাংক মাধ্যমে ১৪১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। গত মাসে ২১৭ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। যা গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় প্রায় ৩৯ শতাংশ বেশি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম