Logo
Logo
×

শেষ পাতা

রাজধানীর তিন সরকারি হাসপাতাল

সব এমআরআই মেশিন নষ্ট

সামর্থ্যবানরা বেশি খরচে বেসরকারিভাবে পরীক্ষা করালেও অসহায় গরিব রোগীরা * কয়েক হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য বাজেট থাকলেও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি নেই

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সব এমআরআই মেশিন নষ্ট

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পাশাপাশি অবস্থিত তিন সরকারি হাসপাতালের সব এমআরআই মেশিন নষ্ট। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটোর/পঙ্গু) এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিটিউট ও হাসপাতাল। শত কোটি টাকা মূল্যের এসব যন্ত্রপাতি দিনে পর দিন অকেজো পড়ে থাকলেও কর্তৃক্ষের তেমন নজর নেই। এমন বাস্তবতায় সামর্থ্যবানরা বেশি খরচে বেসরকারিভাবে পরীক্ষা করলেও ভোগান্তিতে পড়ছেন অসহায় গরিব রোগীরা।

প্রতিষ্ঠান তিনটির কয়েকজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, একজন মানুষের শরীরের ভেতরের কাঠামো ও অঙ্গের বিস্তারিত প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ইমেজিং) পরীক্ষা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষাটি করতে সরকারিভাবে ধরনভেদে রোগী প্রতি দুই থেকে চার হাজার টাকা লাগে। আর বেসরকারি কেন্দ্রে গেলে গুনতে হয় ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু বছরের পর বছর প্রায় হাজার শয্যাবিশিষ্ট রাজধানীর তিনটি বড় সরকারি হাসপাতালে দামি চিকিৎসা সরঞ্জাম অকেজো পড়ে আছে। এ কারণে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটছেন।

জানা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি কেনা হলেও দেড় বছরের মাথায় বিকল হয়ে যায়। কয়েকবার মেরামত করে ব্যবহারের পর ২০২১ সালের ২৭ মার্চ থেকে যন্ত্রটি বিকল হয়ে আছে। শুধু এটি নয়, ১ হাজার ৩৫০ শয্যার এ হাসপাতালটির মোট ২২টি যন্ত্র বহুদিন ধরে নষ্ট। বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের ইনচার্জ (টেকনোলজিস্ট) মালেক শরীফ যুগান্তরকে বলেন, যন্ত্রটি সচল থাকা অবস্থায় দৈনিক গড়ে সাতজন রোগীর কনট্রাস্টসহ এবডোমেন ও লাম্বারের এমআরআই করা হতো। মেশিনটি ম্যাগনেটিক ও হিলিয়াম নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হয়ে আছে। তাই রোগীরা ফেরত যাচ্ছেন।

একজন চিকিৎসক বলেন, সরকারের কেন্দ্রীয় চিকিৎসাযন্ত্র মেরামত কারখানা ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারকে এমআরআই যন্ত্রটি বিকল হওয়ার কথা জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের বিধি মোতাবেক সরবরাহকারী কোম্পানি মেডিটেলকে নিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে মেরামতের চেষ্টা করে। কিন্তু মেডিটেল বেশি দর চাওয়ায় সরাসরি মূল কোম্পানি জাপানের হিটাচির সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। কয়েক বছর আগেও যন্ত্রটি মেরামতের জন্য ২ কোটি টাকা খরচ হবে বললেও এখন ৫ কোটি টাকার কথা বলছে। দীর্ঘ সময় পরও সেই অনুমোদন মেলেনি। ফলে পুরোপুরি অচল হয়ে যেতে বসেছে যন্ত্রটি। এ বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালক ডা. শফিউর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

পাশেই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন (নিটোর তথা পঙ্গু) প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে দুটি এমআরআই ও দুটি সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট হয়ে আছে। এরমধ্যে এমআরআই দুটি একেবারেই নষ্ট। মেরামত অযোগ্য হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেশিন দুটিকে ডেথ ঘোষণা করেছে। সিটি স্ক্যানের দুটি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অকেজো থাকায় পরীক্ষা করাতে রোগীদের বাইরে যেতে হচ্ছে। পঙ্গু হাসপতালে কর্মরত একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি) যুগান্তরকে বলেন, যতটুক জানি প্রত্যেক মেশিন প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল। চালু থাকায় অবস্থায় দৈনিক গড়ে ১০ জনের এমআরআই এবং ১৫ জনের সিটি স্ক্যান করা সম্ভব হতো। এমআরআইর জন্য রোগীদের তিন হাজার এবং সিটি স্ক্যানে দুই হাজার টাকা লাগত। হিটাচি কোম্পানির তৈরি একটি এমআরআই মেশিন ২০২০ সালে, আরেকটি গত বছরের (২০২৩) শুরুর দিকে নষ্ট হয়ে যায়। মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দও হয়েছিল। কিন্তু প্রকৌশলীরা দেখে বলেছেন, মেরামত করে কোনো সুফল আসবে না।

একইভাবে ফিলিপস কোম্পানির তৈরি সিটি স্ক্যানের একটি মেশিন মাস দুয়েক আগে বন্ধ হয়ে যায়। মেরামতের জন্য নিমিউকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারি কাজে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সচল করা সম্ভব হচ্ছে না।

জাতীয় অর্থোপেডিক হা০সপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাকসুদা বেগম বলেন, ‘নিটোরের প্রথম এমআরআই মেশিনটি ২০১৩ সালের শেষর দিকে পুরাতন ভবনে বসানো হয়। সাত বছর চলার পর সেটি অকেজো হয়ে যায়। এরপর মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় এমআরআই মেশিনটি বসানো হয় ২০১৮ সালে। সেটিও গত বছর থেকে বন্ধ। সাধারণত চিকিৎসা ভারী যন্ত্রপাতিগুলোর লাইফ টাইম (স্বাভাবিক মেয়াদকাল) ধরা হয় ১০ বছর পর্যন্ত। এই সময়ের আগে বা পরেও নষ্ট হতে পারে। আর ফিলিপস কোম্পানির তৈরি প্রথম সিটি স্ক্যান মেশিনটি ২০১৪ সালের শুরুতে এবং হিটাচির তৈরি দ্বিতীয় সিটি স্ক্যান মেশিনটি ২০১৮ সালে প্রতিস্থাপন করা হয়। ফিলিপস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দিচ্ছে না। ফলে মেশিনটি কতটুকু নষ্ট, সচলের উপযোগী আছে কিনা জানা যাচ্ছে না। অন্যদিকে হিটাচির মেশিনটি প্রকল্পের অধীনে কেনায় এ বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালক ভালো বলতে পারবেন। তবে আমরা নিমিউসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’

পঙ্গু হাসপাতালেরর বিপরীতে অবস্থিত জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন নষ্ট থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘ফিল্ম সংকটে এমআরআই মেশিন সাময়িক সময় বন্ধ ছিল। নতুন করে ফিল্ম কেনা হয়েছে। রোগীরা সেবা নিতে পারছেন। আর সিটি স্ক্যান মেশিন ২০০৯ সালে স্থাপন করা হয়েছিল। মেশিনটির পার্টস (যন্ত্রাংশ) এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সিমেন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারা বলেছে পার্টস অ্যাভেলইবেল নয়। মেডিকেল যন্ত্রাংশ মেরামতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান নিমিউর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারাও নতুন করে কিনতে এবং পুরাতন মেশিন থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করে; কিন্তু সম্ভব হয়নি। সিমেন্স যেহেতু বলছে পার্টস নেই। সেহেতু এটি আর ভালো হবে না। নতুন মেশিন চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হবে।’

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে উচ্চ মূল্যের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন থাকা রোগীদের জন্য আশীর্বাদের মতো। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বেশিরভাগই ব্যয় হয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়। কিন্তু দামি যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট থাকায় রোগীরা বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। কয়েক হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য বাজেট থাকলেও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কম থাকায় এমনটা হচ্ছে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম