Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড

হাসপাতালে স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ

আহত ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক-স্বাস্থ্যমন্ত্রী * শোকের পাশাপাশি ক্ষোভও স্বজনদের, তারা বলছেন-এটা হত্যাকাণ্ড

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাসপাতালে স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে মারা যাওয়া নাজমুলের মায়ের আহাজারি। শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে -যুগান্তর

হাসপাতালের বারান্দা ও মর্গের সামনে স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। কারও আহাজারিতে কেঁপে উঠছে চারপাশ। কেউ বা শোকে স্তব্ধ-শুধু দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। প্রিয়জনের এমন মৃত্যু বা মুমূর্ষু অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে মৃত ৪৬ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে আহত ১৩ জনের চিকিৎসাও চলছে হাসপাতাল দুটিতে। এদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। 

স্বজনরা বলছেন, এটি শুধু অগ্নিকাণ্ড নয়, হত্যার শামিল। তাই শুধু শোক নয়, তাদের বুকে ক্রোধের আগুনও জ্বলছে। চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা জানান, চোখের সামনেই ধোঁয়ায় বন্দি হয়ে মারা যেতে দেখেছেন অনেককে। 
শুক্রবার ঢামেক হাসপাতাল মসজিদের মাইকে জুমার আজান হচ্ছিল। এ সময় জরুরি বিভাগের মেঝেতে হাহাকার করছিলেন আমেনা বেগম নামে এক মা। 

তিনি চিকিৎসক-নার্সদের বলছিলেন, ‘তোমরা আমার মানিকটাকে আমার বুকে এনে দাও। আমার ছেলে মিনহাজকে (মিনহাজ উদ্দিন) একবার দেখতে দাও। আমার কলিজারে আমি বাড়িতে নিয়ে যাব।’ মিনহাজ পুড়ে একেবারে অঙ্গার হয়ে গেছেন। তাই তাকে দেখতে দেওয়া হচ্ছিল না। একটি বস্তায় তার শরীরের অংশগুলো রাখা হয়েছে। হাত-ঘড়ি দেখেই মিনহাজকে শনাক্ত করেন তার আপনজন। 

মিনহাজ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে বছরখানেক আগে চাকরি নিয়েছিলেন। তার মেজ ভাই মেহেদী হাসান যুগান্তরকে জানান, তারা তিন ভাই। মিনহাজ সবার ছোট। বড় ভাই মাহবুব খান বাসাবোতে থাকেন। তার সঙ্গেই থাকতেন মিনহাজ। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদরের ইসলামপুর গ্রামে। তার বাবা ওলিউল্লাহ খান অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। বড় ভাই মাহবুব কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মিনহাজ আমার সন্তানের মতো ছিল। সে নেই, আমার মা-বাবাকে এখন কি করে বাঁচাব। 

মিনহাজের বন্ধু সৌমিত বলেন, রাতে মিনহাজ, আমিন ও আরও এক বন্ধু মিলে তারা বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে খেতে যান। একপর্যায়ে তিনিসহ আরেক বন্ধু রিফাতকে নিয়ে শ্যামলী যান, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। পরে আমিন ফোন করে জানান, কাচ্চি ভাই রেস্টেুরেন্টে আগুন লেগেছে। সে উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়েছে। মিনহাজ নামতে পারেনি। খবর পেয়ে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আহত আমিনকে হাসপাতালে পাঠান। 

২০ বছরের সাগর হোসেনের লাশ ঘিরে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা মর্গের দরজায় বিলাপ করছিলেন। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। অগ্নিকাণ্ডের সময় সাগর কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলেন। তার চাচা তালেব প্রামাণিক বলেন, আমার ছোট ভাই হাসান প্রামাণিকের ছেলে সাগর। তার বাবা-মা অসুস্থ। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সাগর বড়। তার উপার্জিত অর্থ দিয়েই সংসার চলত। এখন তার পরিবারের কি হবে। এ মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ কে দেবে। 

সাংবাদিকতা করতেন তুষার হাওলাদার ও অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। দুজনই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান। তুষার সম্প্রতি কেস্টারটেক নামে একটি অনলাইন মালটিমিডিয়ায় কাজ শুরু করেন। আর শাস্ত্রী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে কাজ করতেন। তুষারের বাবা দীনেশ চন্দ্র হাওলাদার ঢামেক হাসপাতাল থেকে লাশ বুঝে নেন শুক্রবার সকালে। তিনি শুধু কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘বাবারে তুই আমারে কোথায় রেখে গেলি-বাবা, বাবারে তুই কোথায় চলে গেলি।’

তুষার রাজধানীর গোড়ানে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায়। বাবা চাকরি করেন রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে। কাজ শেষে প্রায় প্রতিদিনই ছেলে আর তিনি একই সঙ্গে বাসায় ফিরতেন। লাশ শনাক্ত করে বাবা বলছিলেন, রাত ৮টায় ছেলের সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল, ছেলে বলেছিল, বাসায় ফিরতে দেরি হবে। তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন-ছেলে কখন বাসায় ফিরবে। পরে শুক্রবার সকালে পুলিশ ফোন করে জানায়, তার ছেলের লাশ ঢামেক হাসপাতাল মর্গে। এদিকে শাস্ত্রীর সহকর্মী গোলাম রাব্বানী জানান, তিনি শাস্ত্রীর লাশ শনাক্ত করেন। শাস্ত্রীর বাড়ি কুষ্টিয়ায়। কিন্তু তার পরিবারের ফোন নম্বর না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। শাস্ত্রী ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। 

সকালে মর্গের সামনে এদিক-ওদিক ছুটছিলেন সৈয়দ গাউসুল আজম নামের এক ব্যক্তি। বিলাপ করে বলছিলেন, তার পরিবারের ৫ জন মারা গেছেন। মর্গের ভেতর গিয়ে প্রিয়জনের লাশ ঘিরে আর্তনাদ করছিলেন। কর্মীরা তাকে বারবার বের করে বারান্দায় নিয়ে আসছিলেন। সৈয়দ গাউসুল আজম জানান, মৃত ৫ জনের মধ্যে মোবারক হোসেন তার বোন জামাই। মোবারক তার পরিবার নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। তিনি বহু বছর ধরে ইতালি থাকেন। গ্রিনকার্ড পাওয়ায় দেশে এসেছিলেন স্ত্রী স্বপ্না, দুই মেয়ে কাসফিয়া, নূর ও ছেলে আব্দুল্লাহকে ইতালি নিয়ে যেতে। থাকতেন রাজধানীর মধুবাগে। বৃহস্পতিবার সবাইকে নিয়ে তিনি কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন রাতের খাবার খেতে। আগুনে পরিবারের সবাই মারা যান। ১০ ফেব্রুয়ারি তাদের ইতালি যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। 

সকাল ৯টায় রিংকু রায় নামের এক ব্যক্তি মর্গের পাশে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ভগবান কি দোষ ছিল আমার বোন, ভাগনে-ভাগনির? তাকে যারা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের চোখেও পানি। রিংকু জানান, তার বোন পপি রানী রায়, ভাগনে তুর্য (৬) ও ভাগনি আদ্রিজা রায় (১২) মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার তারা সবাই বইমেলায় গিয়েছিল। ফেরার পথে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। রিংকু আরও জানান, তার বোন স্বামীসহ রাজধানীর দয়াগঞ্জ জেলেপাড়ায় থাকতেন। সেখানে পোস্তগোলায় তাদের লাশগুলো দাহ করা হবে। 
মর্গের ভেতর ছোট্ট এক মেয়ে শিশুর লাশও রয়েছে। হাসপাতালের একটি ফর্মে লেখা কাগজ শিশুটির বুকে লাগানো। সেখানে লেখা-অজ্ঞাতপরিচয়, বয়স ৫ বছর। মাথার চুলে দুটি ছটি বাঁধা। পায়ে মোজা। প্রিন্টের একটি গেঞ্জি এবং প্যান্ট পরা শিশুটির শরীরে কোনো পোড়া দাগ নেই। তবে নাকে-মুখে কালচে ধোঁয়ার চিহ্ন রয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশুটির পরিচয় পাওয়া যায়নি। 

এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় ১১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এদের একজন কাজী নওশাদ। আগুন লাগার পর আতঙ্কে বাকিদের মতোই নিচে নামার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু ধোঁয়ায় দিশা হারিয়ে সিঁড়ির বদলে ভবনটির উপর তলায় উঠে পড়েন তিনি। আহত সুমাইয়া আক্তার বেডে শুইয়ে কাঁদছিলেন। অন্য একটি বেডে কাতরাচ্ছিলেন স্বামী মেহেদী হোসেন। দগ্ধ ফয়সাল আহমেদ যুগান্তরকে জানান, আগুনের সময় পুরো ভবনে বিদ্যুৎ চলে যায়। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় চারপাশ। উপরের তলাগুলোতে আগুন দেরিতে পৌঁছলেও ধোঁয়ায় একাকার হয়ে যায়। অনেককেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে দেখেছেন তিনি। বার্ন ইউনিটে ভর্তি বাকিদের মধ্যে রয়েছেন সুজন মণ্ডল, রাকিব হোসেন, প্রহিত, অবিনা, আজওয়াত আব্রার, আফজাল হোসেন ও সাদ মাহমুদ। 

শুক্রবার সকালে বার্ন ইউনিটে আহতদের দেখতে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৩ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন মারা গেছেন। জরুরি বিভাগ ও বার্ন ইনস্টিটিউটে এখনো ১১ জন ভর্তি আছেন। অনেকের শরীরের বাইরের অংশে পোড়া নেই, কিন্তু ভেতরে পুড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী দগ্ধদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করার জন্য বলেছেন।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম