ফ্রিল্যান্সারকে মামলা ও ক্রসফায়ারের ভয়
চট্টগ্রামে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেন ডিবি পরিদর্শক
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা উত্তর-দক্ষিণ (ডিবি) পরিদর্শক মো. রুহুল আমিনসহ একটি টিমের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
আবু বকর সিদ্দিক নামে একজন ফ্রিল্যান্সারকে মানি লন্ডারিং ও সাইবার ক্রাইমের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে এই বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। এ টাকার মধ্যে দুই ব্যাংক থেকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ, আর ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার বা (৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা) মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করে গোয়েন্দা পুলিশের টিমটি।
সোমবার রাত ৩টার দিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এসব লেনদেন সম্পন্ন করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি টিম। ভিকটিম আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের কাছে এসব তথ্য দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত যাবতীয় দালিলিক প্রমাণ যুগান্তরের হাতে রয়েছে। আবু বকর সিদ্দিকের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার দরবেশকাটা এলাকায়। নগরীর অক্সিজেন এলাকায় তাদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে।
ভিকটিম আবু বকর ও তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার গুলবাগ আবাসিক এলাকার কয়লারঘরে বারাকা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি কুলিং কর্নারে চা খাওয়ার সময় ডিবি পরিদর্শক মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি টিম আবু বকর সিদ্দিক ও ফয়জুল আমিন ওরফে বেলালকে ফিল্মি স্টাইলে গাড়িতে তুলে নেয়। কেড়ে নেওয়া হয় মোবাইল ফোন ও নগদ টাকাপয়সা।
এরপর হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে মনসুরাবাদ গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিদর্শক রুহুল আমিন ও এসআই আলমগীরের নেতৃত্বে ফয়জুল আমিন বেলালকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এ সময় আবু বকরকে মানি লন্ডারিং ও সাইবার ক্রাইমের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়। বলা হয়, এসব মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দিলে ২০ বছরেও কারাগার থেকে বের হতে পারবে না। আবু বকরকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন পরিদর্শক রুহুল আমিন।
আবু বকরের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৭৮৬৩২৪৫০০০০০৮১৮১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে সোমবার রাত ৩টা ৪১ মিনিট ২১ সেকেন্ডে ০৯৭৩২০১০০০০৩৮৯৪৩ নম্বর হিসাবে ৫ লাখ টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। একইভাবে আবু বকরের সিটি ব্যাংকের ১৪০১৮৮২০২৪০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে রাত ৩টা ৫০ মিনিটে ১৭৮১৪৩০৫৫৫ নম্বর ব্যাংক হিসাবে আরও ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন অভিযুক্তরা। এছাড়াও একই দিন ভিকটিম আবু বকরের বাইনান্স অ্যাকাউন্ট থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৬০ দশমিক ৪৫ টাকা ট্রান্সফার করে নেন ডিবি কর্মকর্তারা।
টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে নন-এফআরআই বা সিএমপির অধ্যাদেশ ১০৩/৯৪ মামলা দায়ের করেন। প্রসিকিউশন নম্বর ৫৭। মামলায় বাদীসহ নয়জনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন নুরুল আরেফিন, এহছানুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন, এসআই মৃদুল কান্তি দে, এএসআই বাবুল মিয়া, এএসআই শাহপরান জান্নাত, কনেস্টবল মো. মমিনুল হক (২০৮২) ও কনেস্টবল আবদুর রহমান (৩৯৬৩)।
পরদিন মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাদের চট্টগ্রাম আদালতে চালান দেয়। আদালত তাদের ১০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। আবু বকর ও বেলাল জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে বের হন।
মঙ্গলবার আদালত থেকে বের হওয়ার পর বুধবার নতুন আরেকটি মোবাইল ফোন কিনে বাইনান্স অ্যাপ ডাউনলোড করে আবু বকর তার অ্যাকাউন্ট অন করে দেখেন ২ লাখ ৮২ হাজার ডলারের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ডলার রয়েছে। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার বা ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে ফেলা হয়েছে। আবু বকর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় এসব ডলার বাইনান্স অ্যাকাউন্ট থেকে স্থানান্তর করা হয়। সোমবার রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে এসব ডলার সরিয়ে ফেলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। আবু বকর সিদ্দিক একজন সরকার অনুমোদিত ফ্রিল্যান্সার। তার আইডি নম্বর এমও ১৬০৯২২৬২৮৬।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বায়েজিদ বোস্তামী থানার গুলবাগ আবাসিক এলাকার কয়লারঘরে বারাকা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি কুলিং কর্নারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানটি বন্ধ। পাশের আরও একটি দোকান বন্ধ। ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী ও পানের দোকানদার সুমি দত্ত যুগান্তরকে জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি মাইক্রোবাস থেকে কিছু লোক পাশের কুলিং কর্নার থেকে ৩ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কারা কেন নিয়ে গেছে, জানি না।
বারাকা এন্টারপ্রাইজের মালিক আরেফিল মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, সোমবার গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় দোকানের সিসি ক্যামেরার মেমোরি কার্ড নিয়ে গেছে। আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।
ভিকটিম আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, ডিবির পরিদর্শক রুহুল আমিন, এসআই আলমগীরসহ ৭-৮ জনের একটি টিম আমাকে বিভিন্ন মামলার ভয় দেখিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফ্রিল্যান্সিং করে ৮ বছর ধরে এসব ডলার জমিয়েছিলাম। অক্সিজেন এলাকায় বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। গোয়েন্দা পুলিশ আমার সারা জীবনের আয় লুট করেছে। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
ভিকটিম ফয়জুল আমিন বেলাল যুগান্তরকে বলেন, আমাকেও কোনো কারণ ছাড়া ধরে চালান করে দিয়েছিল। আমার কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ২ হাজার টাকা নিয়েছে। আরও ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করে গোয়েন্দা পুলিশকে দিতে বলেছে।
এ ব্যাপারে পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, সোমবার রাতে অক্সিজেন এলাকা থেকে দুজনকে গ্রেফতার করেছিলাম। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে। জামিন হয়েছে কি না জানি না। তাদের কাছ থেকে কেন এত বিপুল পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার অফিসে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসব আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর-দক্ষিণ) ডিসি মোছা. সাদিরা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, আমরা এ ধরনের কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।