দুদকের গণশুনানিতে অভিযোগ
এডিশনাল ডিআইজির দখল জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদ
যুগান্তর প্রতিবেদন ও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খাস জলমহাল ইজারা নিয়ে স্থায়ীভাবে দখল করার চেষ্টা করছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। ট্রিপলেক্স বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার কাজ শুরুও করেছিলেন তিনি।
এ অবস্থায় দুদকের গণশুনানিতে বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এর তিন দিনের মাথায় খাসজমি থেকে দখল উচ্ছেদ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইককান্দি ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ায় এই অভিযান পরিচালিত হয়।
কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক একর ৭ শতক জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় জেলা প্রশাসন। জমি দখলমুক্ত করে তারকাঁটার বেড়ায় ঘিরে সেখানে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনে গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোসা. নাজমুন নাহারের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি টিম সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায়।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলাম শিমুল নিজেও। কিন্তু তার কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা পুলিশের সিটি এসবিতে কর্মরত।
কয়েক বছর এই দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানান পুলিশ কর্মকর্তার ভাতিজা আজম আলী শেখ। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষে সরেজমিন তদন্তও হয়। কিন্তু পুলিশের শীর্ষ পদে থাকায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে দখল ছেড়ে দিতে রফিকুল ইসলামকে বলছিলেন। কিন্তু এর পরও সেখানে স্থায়ী সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের পাঁয়তারা চলছিল।
এর মধ্যেই ১৪ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জে দুদকের গণশুনানি চলাকালে অবৈধ দখলের অভিযোগ করেন আজম আলী খান। তার বাড়ি সদর উপজেলার মোচড়া গ্রামে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্রে দেখা গেছে, জেলার বিজয়পাশা মৌজায় ৫৬৯ দাগে পুলিশ কর্মকর্তার আলোচ্য দখল নিয়ে জেলা প্রশাসন সরেজমিন তদন্ত করে। পাইককান্দি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. মুহসিন শেখ এ বিষয়ে ২০ আগস্ট একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজয়পাশা মৌজার বিআরএস ৫৬৯ দাগটি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত। সেখানে জমির পরিমাণ ২ একর ৫২ শতক। জমির শ্রেণি-গোচর। ওই দাগের মধ্য দিয়ে পাকা রাস্তা যাওয়ায় বিআরএস নকশায় ৫৬৯ দাগে এক একর ৭ শতক ডোবা। আর ৫৭০ দাগ নকশায় থাকলেও রেকর্ডে ছুট দাগ হিসাবে আছে।
আলোচ্য ৫৬৯ দাগের পূর্বাংশে ত্রিভুজাকৃতির ২২ শতাংশ এবং তারই পশ্চিম পাশে অপর খণ্ডে ত্রিভুজাকৃতির ৪ শতকসহ মোট ২৬ শতক জমি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে মাহফুজ শেখ ও তার ভাই পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম শিমুল নিজ বসতবাড়ির সঙ্গে একীভূত করেন। সেখানে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের লোহার পাইপ দ্বারা ঘেরাও করে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধ করা হয়। ইতোমধ্যে উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার কর্তৃক পরিমাপ করে সরকারি জায়গার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামসহ তার পরিবার অবৈধ দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এমনকি অবৈধ দখল ঠেকাতে লাল নিশানও দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোসা. নাজমুন নাহার বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আমরা কিছু দিন ধরে খাসজমি উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আসছি। বেদখল হওয়া এসব জমি অনেক মূল্যবান। জেলার ৫টি উপজেলায় আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসিন উদ্দীন বলেন, দুদকের গণশুনানি চলাকালে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলামের পরিবারের বিরুদ্ধে সরকারি খাসজমি দখল এবং সেখানে প্রাচীর নির্মাণের অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখল উদ্ধার করে সেখানে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পাইকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আকতারুজ্জামান আকতু বলেন, অবৈধ দখলকৃত জমিটি এক সময় গোচারণভূমি ছিল। এলাকার যুবকরা ফুটবল খেলত। ২০-২৫ বছর আগে ওই জমিটি স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে নেয়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জমি উদ্ধার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হওয়ায় এলাকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।
অভিযানে অন্যান্যের মধ্যে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাম্মী কায়সারসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেয়। এ বিষয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলামের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে বারবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।