রেলের জমি উদ্ধারে আইনের কার্যকর প্রয়োগ নেই
সীতাকুণ্ডে তিনশ কোটি টাকার ভূমি বেদখল
উদ্ধার অভিযানে রেল কর্তৃপক্ষ, সফলতা নিয়ে সংশয় * দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে-রেলপথমন্ত্রী
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
রেলের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাওয়া একরকম ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে। রেলের জমি উদ্ধারে কঠোর আইন থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগে তেমন কোনো তৎপরতা নেই। বর্তমানে রেলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর জমি দখলদারদের কবলে রয়েছে। উদ্ধার হলেও তা আবার বেদখল হয়ে যায়-এমন মন্তব্য খোদ রেল কর্মকর্তাদের। সম্প্রতি পূর্বাঞ্চল রেলের সীতাকুণ্ডে প্রায় ৩শ কোটি টাকার ৫০ একর ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। এলাকার চিহ্নিত একাধিক ভূমিদস্যুর নেতৃত্বে এই সম্পত্তি দখলে নেওয়া হয়। সেখান বসবাসরত প্রায় ৫০০ পরিবারকে (অধিকাংশ রেলের কর্মচারী) উচ্ছেদ করে অবৈধ দখলদাররা। এরপর প্রকাশ্যে স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই জমির চারপাশে টিন দিয়ে বেড়া দেয় তারা। প্রতিকার চেয়ে দুই ভূমিদস্যু ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরপর জমি দখল মুক্ত করতে মাঠে নেমেছে। কিন্তু এ অভিযান কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম যুগান্তরকে বলেন, সীতাকুণ্ডে রেলের জমি দখল মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে আছেন। দখল মুক্ত করা হচ্ছে ওই জমি। নিশ্চয়ই দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। রেলের কোনো জমি বেদখলে থাকবে না। নিজ থেকে উচ্ছেদ না হলে কিংবা জমি লিজ নেওয়ার যথাযথ ডকুমেন্ট না দেখাতে পারলে-কাউকে রক্ষা করা হবে না। রেলের জমি উদ্ধার করে পরিকল্পনা অনুযায়ী বরাদ্দ এবং স্থাপনা তৈরি করা হবে। অব্যবহৃত জমি কাজে লাগিয়ে আয় বাড়ানো হবে। কারও দখলে রেলের জমি থাকবে না। জমি উদ্ধারে যা যা করণীয় তা করা হবে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড মডেল থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে ফিল্ড কানুনগো মো. মনিরুল ইসলাম ওই অভিযোগ করেছেন। থানা পুলিশ তা আমলে নিয়ে তদন্ত করছে। আসামিদের ধরতে মাঠে নেমেছেন। আমরা ৭ ফেব্রুয়ারি থানায় অভিযোগ দিয়েছি। সীতাকুণ্ডের কুমিরা রেলওয়ে স্টেশনের আওতাধীন এ জমি দখলে নেয় অভিযুক্তরা। মো. মহমিস রেজা এবং মোহাম্মদ আলী নামের দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী নিশ্চিত পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে-এমনটাই আমরা আশা করছি।
রেলওয়ে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ভূমিদস্যুরা স্টেশনসংলগ্ন রেলের উল্লিখিত মূল্যবান জমি দখলে নামে। গত কয়েক দিনের মধ্যে প্রকাশ্যে রেলের জমি ঘিরে লোহা-টিন দিয়ে বেড়া দিয়ে ফেলে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বেড়া দিয়ে মাটি ভরাট এবং টিনের ঘর তৈরি করতে থাকে। বেআইনিভাবে মাটি ভরাট বন্ধ করে বেড়া অপসারণের কথা বলা হলে ভূমিদস্যুরা সংশ্লিষ্টদের ভয়ভীতি দেখায়। মাটি ভরাট এবং বেড়া যাতে আর না দিতে পারে-সেজন্যই থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। উদ্ধারে অভিযানও চলছে। কিন্তু যে কোনো সময় ভূমিদস্যুরা পুনরায় মাটি ভরাট ও বেড়া দিতে পারে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে ভূমিদস্যুরা রেলের জমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট ও টিন দিয়ে ঘেরাও করছিল। আমরা রেলের পক্ষ থেকে বাধা দিয়েও পারছিলাম না। তবে রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী দখলকৃত টিনের বেড়া উচ্ছেদ করছি। ভরাট মাটি সরানোর চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ভয়ভীতির বিষয়টি সামনে আসছে-আমরা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছি। রেলের এ জমির মূল্য কোটি কোটি টাকা। বেদখলে থাকা জমি উদ্ধারে আমরা মাঠে রয়েছি। এ ক্ষেত্রে পুলিশি সহযোগিতা জরুরি। প্রথমিকভাবে আমরা ভূমিদস্যুদের করা অফিস ও সাইনবোর্ড ভেঙে দিয়েছি।
রেলের ওই জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কলোনিবাসীর ভাষ্য, কুমিরা এলাকার চিহ্নিত প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা তাদের জোরপূর্বক কলোনি থেকে উচ্ছেদ করে পুরো জমি দখলে নেয়। থানায় অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে অনেক কলোনিবাসী অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। ভূমিদস্যুরা রেলের জায়গা দখল করে একটি অফিস ও ‘অ্যাগ্রিকালচার অ্যাগ্রো’ নামে কয়েকটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়।
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেললাইনে দুপাশের (১০ ফুট করে ২০ ফুট) জায়গায় কোনো স্থাপনা করা যাবে না। বেআইনিভাবে রেলের অব্যবহৃত ভূমিতে কোনো স্থাপনা করা যাবে না। এমন আইনি বাধা থাকলেও পুরো রেলে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর জমি ভূমিদস্যুদের দখলে রয়েছে। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ করা হলেও সেই সব জায়গা পুনরায় বেদখলে চয়ে যায়। রেলের অব্যবহৃত জমিতে কী ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হবে কিংবা কোন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ভাবে লিজ দেওয়া হবে-এমন পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত ভাবে নেওয়া হয়নি।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, সীতাকুণ্ডে রেলের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। তবে রেলের জমি উদ্ধার করে যথাযথ কাজে লাগাতে না পারায় ফের দখলে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কুমিরা স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যে রেলের জমি দখলের ঘটনায় আমরা কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি। এ জমি পুরোপুরি উদ্ধার করে রেলের আওতায় আনা হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছি।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েছি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করব। অভিযুক্তরা আমাদের নজরদারিতে আছে।
জমি উদ্ধারে নতুন আইন হলেও তৎপরতা নেই : জবরদখলে থাকা রেল বিভাগের সম্পত্তি উদ্ধারে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করছে সরকার। বাংলাদেশ রেলওয়ের যেসব ভূমি, ভবন, জলাশয়, গাছপালা ও স্থাপনাদি অথবা এর অংশবিশেষ যা রেল কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে দখলে রাখা হয়েছে তা নতুন আইন প্রয়োগ করে উদ্ধার করা হবে। এ ছাড়া লাইসেন্স বা ইজারা বা বন্দোবস্তের বা ভাড়ায় যেসব সম্পত্তি রয়েছে তার মেয়াদ অবসানের পর তা আর কেউ দখলে রাখতে পারবে না। সম্পত্তি উদ্ধারে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশ রেলওয়ে স্থাবর সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইন-২০২১ নামে অভিহিত হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ নেই বললেই চলে-এমন মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।