তথ্য অধিকার আইন
আওতামুক্ত থাকতে চায় গোয়েন্দা শাখাগুলো
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর * গোপনীয়তা রক্ষা ও তথ্য প্রকাশ ঠেকাতে আওতামুক্ত থাকতে চায় পিবিআই ও এটিইউ
ইমন রহমান
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তদন্তের গোপনীয়তা রক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ ঠেকানোর লক্ষ্যে তথ্য অধিকার আইনের আওতামুক্ত থাকতে চাচ্ছে পুলিশ। এজন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আইনটির ধারা-৩২ অনুযায়ী তফশিলভুক্ত হতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কতিপয় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নহে।’ অবশ্য শুরু থেকেই এ আইনের আওতামুক্ত রয়েছে সিআইডি, এসবি ও র্যাবের গোয়েন্দা সেল। সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (পিবিআই) নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে এ আইনের আওতামুক্ত থাকতে চাচ্ছে। এজন্য নতুন করে পুলিশ সদর দপ্তরকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে চিঠি দিয়েছে।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণ মানুষের তথ্য জানার অধিকার আছে। এ অধিকার খর্ব হলে পুলিশি রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত হবে দেশ। এ বিষয়ে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ধরনের কাজ করে তার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের অনেক সময় তথ্য জানার অধিকার থাকাটা বেশি প্রয়োজন। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততার কারণে তাদের ব্যাপারে তথ্য প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘যে তথ্য প্রকাশ করলে মামলার তদন্তে বিঘ্ন ঘটবে সেসব হয়তো না দেওয়ার একটা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবে না এটা ঠিক নয়। এমনটা হলে বিদেশিরা তখন আমাদের পুলিশি রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করবে। বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক যুগান্তরকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্য সব সময় গোপনই থাকে। সেগুলো যদি প্রকাশ্যে আনা হয় তবে অনেক রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। তদন্ত ব্যাঘাত ঘটবে, ব্যক্তির নিরাপত্তার সমস্যা হয়। ইনভেস্টিগেশনের (অনুসন্ধান) বিষয়গুলো গোপন রাখাই ভালো।
রাষ্ট্রের গোপন জিনিস প্রকাশ হলে রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো হুমকির মুখে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইনভেস্টিগেশনের কিছু বিষয় আছে সেগুলো যদি লিক (ফাঁস হয়) হয়, সেক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশন ব্যাঘাত ঘটে। ইনভেস্টিগেশনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের অনেকে ঝুঁকিতে থাকে।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তথ্য অধিকার আইন বলে অনেক মামলার আসামি বা বাদী সাক্ষীর জবানবন্দি বা তদন্ত প্রতিবেদন চান। এসব তথ্য প্রকাশ পেলে সাক্ষীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তদন্তেরও ব্যাঘাত ঘটে। কুমিল্লার রেইসকোর্স এলাকার ধানমন্ডি রোডের বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল আলম তথ্য অধিকার আইনে তার করা একটি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য ও পিবিআইর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন চান। এসব তথ্য গোপীয় এবং প্রকাশ পেলে সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছে পিবিআই।
তবে তথ্য চাওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ অনেক সময় প্রভাবিত হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। এ প্রেক্ষিতে পুলিশের ওই সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো শাস্তি না হওয়ার নজির রয়েছে। ফলে তদন্তের বিষয়ে জানার অধিকার আছে ভুক্তভোগীদের। তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়েও অনেক ভুক্তভোগী তথ্য পান না বলে দাবি করেছেন।
ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল আলম যুগান্তরকে বলেছেন, মামলা তদন্ত করে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআইর কর্মকর্তারা। গত সাত মাস আগে সেই প্রতিবেদনের বিষয়ে তথ্য অধিকার আইনে জানতে চাইলেও কোনো তথ্য দেয়নি সংস্থাটি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কাজের ধরন ও প্রকৃতিগত কারণে সব সময় সব তথ্য ইউনিটের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ফলে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর ধারা-৭ অনুযায়ী কিছু বিষয় সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর তথ্যগুলোকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। দেশের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থ বিবেচনায় তথ্য অধিকার আইনের ধারা-৩২ অনুযায়ী তফশিলভুক্ত করে কিছু প্রতিষ্ঠানকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
খসড়া প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা পিবিআই যা ২০১১ সালে গঠিত হয়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু করে। শুধুই তদন্ত কার্যক্রমকে ফোকাস করে কাজ করতে থাকা এই সংস্থার অধিকাংশ তথ্য নিরপেক্ষ তদন্ত-সম্পাদন ও জনস্বার্থ রক্ষায় প্রকাশ না করার ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থার তালিকায় থাকা যৌক্তিক ও সুষ্ঠু তদন্ত কার্যক্রমের সহায়ক। তাছাড়া ২০১৭ সাল থেকে জঙ্গি কার্যক্রম ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে।
উল্লেখিত কার্যক্রমের লক্ষ্যে এটিইউকে অনেক স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই এসব তথ্যাদি প্রকাশ করা হলে সামগ্রিকভাবে এ ইউনিটের কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা সেল/শাখাগুলোর কার্যক্রমও নিরাপত্তাজনিত কারণে জনস্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয়। এমতাবস্থায় পিবিআই, এটিইউ ও বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা সেল বা শাখাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত ও সমুন্নত রাখার জন্য তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর আওতাবহির্ভুক্তির তফশিলভুক্ত করা প্রয়োজন।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো পিবিআই প্রধানের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, পিবিআই মামলা তদন্তকালে বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া অথবা ভুক্তভোগী তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর বিধান মতে তথ্য চেয়ে আবেদন করে থাকেন। তদন্তাধীন মামলা ছাড়াও বিভাগীয় তদন্তের কপি এমনকি ফৌজদারি মামলার সাক্ষীর বক্তব্যের কপিও পেতে আবেদন পাওয়া যাচ্ছে। ফলে তথ্য প্রদান করার ক্ষেত্রে পিবিআইকে বিব্রতকর পরিস্থিতিসহ আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে পিবিআই প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘বাদী বা বিবাদীরা অনেকে তথ্য অধিকার আইন বলে সাক্ষী ও আসামিদের ১৬১ ধারায় দেওয়া বক্তব্য এবং তদন্ত প্রতিবেদন চাচ্ছেন। একটা লোক যখন তথ্য চান, আমি দিতে চাই। কিন্তু আমি তাকে তথ্য দিতে গেলে অন্য লোকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
পিবিআইর চিঠির জবাবে গত ১৬ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে খসড়া প্রস্তাব ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এ খসড়া প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।