ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ আত্মসাতে চাপ
বরাদ্দ তহবিলের ৬০ শতাংশ চায় তিন বিনিয়োগকারী * বিএসইসি বলছে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে
মনির হোসেন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেয়ারবাজারে বহুল সমালোচিত চার ব্রোকারেজ হাউজের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ‘বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল’ থেকে দেওয়া এ অর্থ ১০ হাজার বিনিয়োগকারীর মধ্যে ভাগ করে দিতে চাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের পাওনা টাকার ১০ থেকে ১২ শতাংশ পাবেন। কিন্তু তহবিলের ১৫ কোটি টাকা অর্থাৎ বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ শতাংশই মাত্র ৩ বিনিয়োগকারী নিয়ে যেতে চাচ্ছে। তাদের টাকা দিতে প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল থেকে কমিটিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ৯ জুলাই যুগান্তরে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর উদ্যোগটি নেয় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ বণ্টনের ব্যাপারে বিএসইসির একটি নির্দেশনা আছে। সেই নির্দেশনার বাইরে যাওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক না। বিষয়টি নিয়ে বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তারা বলছেন, এ অর্থ সুষ্ঠু বণ্টন না হলে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টি এ মুহূর্তে বাজারের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করবে। ফলে এ ব্যাপারে বিএসইসির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে বিএসইসি বলছে, এ ব্যাপারে গাইডলাইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, দু-একটি ব্রোকারেজ হাউজ বেআইনি কার্যক্রম পরিচালনার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল থেকে টাকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। এ ক্ষতিপূরণের টাকা কীভাবে দিতে হবে, সে ব্যাপারে বিএসইসির একটি গাইডলাইন দেওয়া আছে। এ গাইডলাইন অনুসারেই স্টক এক্সচেঞ্জকে টাকা দিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, শেয়ারবাজারে বহুল সমালোচিত ৪টি ব্রোকারেজ হাউজ জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ হাজার বিনিয়োগকারীর ২৬৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে তামহা সিকিউরিটিজ ৫১ কোটি ৩০ লাখ, ক্রেস্ট ৬২ কোটি ৯৮ লাখ, বানকো সিকিউরিটিজ ১৩৬ কোটি ৮৪ লাখ এবং শাহ মোহাম্মদ সগীর সিকিউরিটিজ ১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এদিকে বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর পক্ষ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়ার পর ওই সময়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা যুগান্তরকে বলেছিলেন বানকো সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যানে আবদুল মুহিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাউজটির পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোনে কল ঢুকলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। একইভাবে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তামহা সিকিউরিটিজের এমডি ডা. হারুনুর রশীদ। কিন্তু বৃহস্পতিবার তাকে কল করা হলে একজন নারী রিসিভ করেন। যুগান্তরের পরিচয় দেওয়ার পর রং নম্বর বলে সংযোগ কেটে দেন। কথা বলার জন্য বাকি দুই প্রতিষ্ঠানের কাউকে পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় হাউজগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল থেকে সামান্য কিছুটা ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের এ সুরক্ষা তহবিল নিয়ে চলতি বছরের ৯ জুলাই রিপোর্ট প্রকাশ করে যুগান্তর। এরপরই বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশের পর নানা নাটকীয়তা শেষে ২৬ কোটি টাকার হদিস মিলেছে। সেখান থেকে ২৫ কোটি টাকা ১০ হাজার বিনিয়োগকারীকে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ক্ষতির অনুপাত অনুসারে ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রাথমিকভাবে দেওয়া হবে। এতে একজন বিনিয়োগকারী ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পেতে পারেন। কিন্তু এটি মানতে নারাজ বড় তিন বিনিয়োগকারী। তারা ১৫ কোটি টাকা নিয়ে যেতে চান। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করছেন। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে, যারা এ টাকা পাবেন, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তদবিরের জন্য প্রভাবশালীদের দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ব্যাপারে রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছে কমিশন।
জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবদুস সামাদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কমিশন থেকে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের টাকা দিতে বলা হয়েছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে টাকা বণ্টন করা আমাদের জন্য কঠিন। এরপর ডিএসইকে তহবিল হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছি। কীভাবে বণ্টন করবে, এখন সেটি তাদের ব্যাপার। তবে প্রতিমাসেই কিছু টাকা তহবিলে যোগ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের ক্ষতি হলে তাদের রক্ষা করতে ‘বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল’ গঠন করা হয়। দুই স্টক এক্সচেঞ্জেরই এ তহবিল রয়েছে। মূলত তিনভাবে অর্থ আসে। প্রথমত, ব্রোকারেজ হাউজ প্রতিবছর এই তহবিলে কিছু অর্থ দেয়। দ্বিতীয়ত, স্টক এক্সচেঞ্জ থেকেও কিছু টাকা দেওয়া হয়।
তৃতীয়ত, এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদাকরণ) স্কিম অনুসারে যেসব সদস্যপদের মালিক খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেসব পদের লভ্যাংশ এবং পুঁজিভূত সব অর্থ এই তহবিলে জমা করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এতদিন এসব বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ডিএসই। যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিএসইসির পরিচালক মো. মনসুর রহমানকে। এতে সদস্য হিসাবে আছেন অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, উপপরিচালক বনি আমিন খান, সহকারী পরিচালক অমি কুমার সাহা এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএল-এর মহাব্যবস্থাপক রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটি এখনো কাজ করছে।