Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অসহনীয় যানজটে কাবু রাজধানীবাসী

সভা-সমাবেশ ‘শকওয়েভ’ তৈরি করছে * শুধু অবকাঠামো তৈরি করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অসহনীয় যানজটে কাবু রাজধানীবাসী

রাজধানীর বনানীর বাসিন্দা সিফা বেগম মঙ্গলবার সকাল ৭টায় দুই মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন। ছোট মেয়েকে রামপুরার একটি মাদ্রাসায় দিয়ে বড় মেয়েকে নিয়ে রওয়ানা হন ফার্মগেটের উদ্দেশে। ফার্মগেটে একটি কোচিং সেন্টারে মেয়েকে দিয়ে ফের রামপুরার উদ্দেশে রওয়ানা হন। এর মধ্যেই কেটে গেছে ৬ ঘণ্টা। দুপুর ২টার দিকে বাংলামোটর মোড়ে কথা হয় সিফা বেগমের সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ফার্মগেট থেকে বিআরটিসির বাসে বাংলামোটর আসতেই সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা। অথচ যানজট না থাকলে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট লাগার কথা।’

সিফা বেগমের মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন যানজটের যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে রাজধানীতে চলাচল করেন। তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় রাস্তায় কেটে যাচ্ছে। রাজধানীবাসীর এখন অন্যতম সমস্যা যানজট। দিন যত যাচ্ছে, এ সমস্যা ততই বাড়ছে। যানজটের কারণে শিক্ষার্থীরা সময়মতো স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। পরীক্ষার সময় দেরি হয়ে যায়। অন্যদিকে অফিস-আদালতসহ নানা কাজে নিয়োজিতরা সময়মতো পৌঁছাতে পারছেন না। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। অ্যাম্বুলেন্স সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছতে না পারায় গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা পেতে দেরি হচ্ছে। পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

যানজট নিরসনে রাজধানীতে মেট্রোরেল, এলিভেটেড-এক্সপ্রেসওয়ে সীমিত আকারে চালু হয়েছে। কিন্তু যানজট নিরসন হচ্ছে না। সারা বছর রাজধানীতে যানজটের সমস্যা থাকলেও সম্প্রতি এ সমস্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল, শৃঙ্খলা না মেনে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা ইত্যাদি যানজটের অন্যতম কারণ। শুধু অবকাঠামো তৈরি করে রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

আর ট্রাফিক পুলিশ বলছে, সম্প্রতি যানজট বৃদ্ধির প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ। ডিএমপির এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিদিন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো কর্মসূচি থাকে। এ কারণে সব দিকে ব্যালেন্স করা যায় না। একটা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হলে বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল আসে। এ সময় সব রাস্তা বন্ধ করে আগে মিছিল যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে রাজধানীতে যানজটের কারণে দৈনিক প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার সমান। এ হিসাবে বছরে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’

এতে আরও বলা হয়, ‘২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অর্থাৎ ১৫ বছরে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমেছে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটারের মতো।’

এ সম্পর্কে এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘অবকাঠামো তৈরির ফলে সড়কের সক্ষমতা যতটুকু বাড়ছে তার চেয়ে বেশি যানবাহন সড়কে নামছে। ফলে অবকাঠামোর ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। সড়কের সক্ষমতার চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি গাড়ি হয়ে গেছে।’

ঢাকা শহরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল চালু হলেও যানজট কেন কমছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে নিচের সড়ককে যুক্ত করে দিয়েছি। যেখানে এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ ৮০ কিমি. সেখানে নিচের সড়কের গতিবেগ ৫ কিমি.। ফলে এক্সপ্রেসওয়ের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া মেট্রোরেলের সুবিধা তৈরি করতে হলে ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলকারীদের মেট্রোরেলে নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ সড়কের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। এই চাপ পিক অফ-পিক মানে না। যখন অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয় তখন ‘শকওয়েভ’ তৈরি হয়। এই শকওয়েভ দিনব্যাপী থাকে যা যানজটের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।’

মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে। কাওরান বাজার মোড়ে যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা শিকড় পরিবহণের (ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-০৩৪৮) চালকের সহকারী মো. হারুন বলেন, ‘দুপুর ১২টায় মিরপুর ১০ নম্বর থেকে যাত্রা শুরু করে কাওরান বাজার আসতেই আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছে। অন্য সময় এ পথ আসতে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা সময় লাগে।’

তেজগাঁও লাভ রোডের মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, মগবাজার ফ্লাইওভার পর্যন্ত যানজট। সেখানে সিএনজি অটোরিকশায় আটকে থাকা পুলিশ সদস্য বেলাল হোসেন জানান, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে মেয়েকে নিয়ে মিরপুরের বাসায় যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড যানজটে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে তার মেয়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘একটি আদর্শ শহরে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ সড়ক থাকার কথা। তবে ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৭ ভাগেরও কম। ঢাকা শহরে প্রায় ৩০০ কিমি. সড়ক আছে। এর মধ্যে গাড়ি বেশি চলে এমন সড়ক ২০০ কিমি.। এসব সড়কে গাড়ি চলার ক্ষমতা আছে দিনে তিন লাখ। অথচ চলে ১৫ লাখ। অযান্ত্রিক যানবাহন যানজট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে দরকার শক্তিশালী পলিসি।’

তারা বলেন, ‘প্রথমেই আমাদের যানবাহনের সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা শহরের ৩০ থেকে ৪০ ভাগ মানুষ বাস সার্ভিস ব্যবহার করে। এ সার্ভিসকে একটা শৃঙ্খলায় আনতে পারলে, গুণগত মান ঠিক করতে ও যাত্রীর চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে পারলে নিঃসন্দেহে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে আসবে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান বলেন, ‘মানুষের মুভমেন্ট আমরা থামাতে পারি না। আমরা ট্রাফিক শৃঙ্খলা বজায় রাখি। ভোরে, সকালে, বিকালে ও দুপুরে একেক সময় ট্রাফিক জ্যাম একেক রকম হয়।’

রাজনৈতিক কর্মসূচি যানজট আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাস্তবতা ধরেই আমাদের ট্রাফিক পরিকল্পনা করতে হয়, ঢাকা এরকমই।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম