অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নেপথ্যে ৬ কারণ
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ধীরগতি
পিআইসি সভায় প্রশ্নের মুখে সংশ্লিষ্টরা * কাজে ঠিকাদারের চরম অনাগ্রহ বিরাজ করছে * নানা বাস্তব কারণেই ধীরগতি আছে-প্রকল্প পরিচালক
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ধীরগতি বিরাজ করছে ‘বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই-প্রথম পর্যায়’ প্রকল্পে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত ভৌত বা বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ শতাংশ আর আর্থিক আরও কম অর্থাৎ ৫৭ দশমিক ২২ শতাংশ হয়েছে। এতে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। তবে এর জবাবে তারা জানিয়েছেন, অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদারের কাজে অনীহাসহ নেপথ্যে রয়েছে ৬টি কারণ। ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) সভায় বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৭৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০২২ সালে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩০২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। তবে এখন শেষ পর্যায়ে এসে প্রকল্পটির ব্যয় কমছে ১০৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এটির সমাপনী ব্যয় হিসাবে ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এর মধ্যে কাজের অগ্রগতি কম হওয়ায় এ সংশোধনীতে দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও বাস্তবায়ন আশাব্যঞ্জক নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ এনামুল হক মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম এখন অনেক বেড়েছে। এ রকম বাস্তব নানা কারণেই প্রকল্পটির গতি একটু কম। মানহীন কাজ করার চেয়ে ধীরে কাজ করাটাই ভালো। আমরা মানসম্মতভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চূড়ান্ত হিসাবে প্রকল্পের ব্যয় কিছুটা কমবে। কারণ আমরা অধিকাংশ কাজ প্রায় ১০ শতাংশ কম দামে করাতে পেরেছি। এছাড়া ডিজাইনসহ কিছু কাজের ক্ষেত্রে ডিপিপিতে যা ব্যয় ধরা ছিল তার চেয়ে কম দামে করাতে পেরেছি। এটা ব্যয় সাশ্রয় করেছে।
সভা সূত্র জানায়, পিআইসি সভায় বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রকল্পের অতিবাহিত সময়ের তুলনায় ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি কম হওয়ার কারণ জানতে চান। এ সময় প্রকল্প পরিচালক জানান, নির্মাণসামগ্রী ও শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদারদের কাজে চরম অনাগ্রহ রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য কারণও। সেগুলো হচ্ছে-প্রকল্প এলাকায় দুর্গম পরিবেশ, লোকালয় দূরবর্তী, সমুদ্রতীরবর্তী বৈরী আবহাওয়া এবং স্থানীয় শ্রমিকের অপ্রতুলতা। পাশাপাশি সাইটের কিছু অংশে ভরাট মাটির পর্যাপ্ত সেটেলমেন্ট না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে সাইট হস্তান্তর করা যায়নি। এছাড়া খালের গতিপথ পরিবর্তনের কারণে সংলগ্ন স্থাপনার কাজ বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। চলমান বর্ষায় ভবন ছাড়া অন্য সব কাজ বাস্তবতার কারণে স্থগিত রাখা হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কাজের লেভেলিং ও ড্রেসিং সংক্রান্ত মেরামতে দেরি হওয়ায় মাটি ভরাট কাজের চূড়ান্ত বিল দেওয়া যায়নি। এসব কারণে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও প্রকল্পটির আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।
সূত্র আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। এটি চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলায় সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বেপজা জানায়, শিল্প প্লটের সংখ্যা ২৫০টি থেকে বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনীর সময় ৫৩৯টি করা হয়েছে। এতে ভূমি উন্নয়ন ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ বেড়ে যায়। ওই সময় কয়েকটি অঙ্গের ব্যয় হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে সামগ্রিক ব্যয়ও বাড়ে। প্রকল্পে ফায়ার স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, ২টি কারখানা ভবন, ফুটপাত, গাড়ি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, ৩টি আবাসিক ভবন, ১টি মসজিদ ও ১টি মেডিকেল সেন্টার নির্মাণসহ কয়েকটি নতুন অঙ্গ সংযোজন করা হয় সংশোধনের সময়ই। এখন নতুন করে সীমানা দেওয়ালের জন্য অনুমোদিত অঙ্গভিত্তিক বরাদ্দ থেকে ১৭ কোটি টাকা বাড়বে। এ পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশনের পূর্বানুমতি নিয়ে কাজটি করার পক্ষে মত দেন সভায় অংশগ্রহণকারীরা।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে এক কোটি ১৫৬ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন, ৩ লাখ ৬৪ হাজার বর্গমিটার রাস্তা ও ৩৮ হাজার ৭৮৫ বর্গমিটার ফুটপাত নির্মাণ, ৬১ হাজার ২৮৩ মিটার ড্রেন, ৯ হাজার ৩৬৮ মিটার বারবেড ওয়ার ফেন্সিং ও ৪ হাজার ৪৬৫ মিটার সীমানা দেওয়াল নির্মাণ, ৩ হাজার ৫১৬ বর্গমিটার অফিসার্স ডরমিটরি ও ২ হাজার ১১৬ বর্গমিটার স্টাফ ডরমিটরি ভবন নির্মাণ।
এই কার্যক্রমে আরও আছে, তিন ধরনের মোট ১৪ হাজার বর্গমিটার আবাসিক ভবন, ৫ হাজার বর্গমিটার ইনভেস্টরস ক্লাব ও ৫ হাজার ৬২১ বর্গমিটার জোন সার্ভিসেস কমপ্লেক্স নির্মাণ, ২ হাজার ৬০৩ বর্গমিটার সিকিউরিটি ও কাস্টমস ভবন (২টি), ৩৭ হাজার ৫৮২ বর্গমিটার কারখানা ভবন নির্মাণ ইত্যাদি।
সভায় ডাবরখালী খালের খনন বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জানান, খাল খনন কাজের অগ্রগতি হয়েছে ১৬ শতাংশ। তবে বর্ষার কারণে বর্তমানে এ কাজটি বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ১৪২টি ক্রয় প্যাকেজের মধ্যে ৬৬টি প্যাকেজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ৭৩টি প্যাকেজের কাজ বাস্তবায়নাধীন। তিনটির কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। এর মধ্যে গার্বেজ ট্র্যাক কেনার জন্য অর্থ বিভাগের অনাপত্তি গ্রহণের কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি ইনভেস্টর্স ক্লাবের জন্য লিফট কেনা এবং এসটিপি নেটওয়ার্ক নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।
সূত্র জানায়, সভায় পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান সৈয়দা সামিরা বলেন, ইনভেস্টর্স রেসিডেন্স ভবনের ধারণাটি ভালো। এটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে। এ সময় প্রকল্প পরিচালক জানান, এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫টি ইনভেস্টর্স রেসিডেন্স, ২ হাজার জন বিদেশি কর্মীর ডরমেটরি এবং ২ হাজার জন নারী ও পুরুষ ডরমেটরি আবাসন ভবন তৈরির জায়গা আছে। এর মধ্যে একটি ইনভেস্টর্স ক্লাবের আংশিক নির্মাণ করা হচ্ছে। পরে চাহিদার প্রেক্ষিতে অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।