Logo
Logo
×

শেষ পাতা

গোপনে তৎপর উগ্রবাদী নিত্যনতুন সংগঠন

নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে কারামুক্ত জঙ্গিরা

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গোপনে তৎপর উগ্রবাদী নিত্যনতুন সংগঠন

উগ্রবাদী নিত্য-নতুন সংগঠন গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তারা যোগাযোগের বড় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার জঙ্গিরা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। আর এসব নতুন উগ্রবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় কলকাঠি নাড়ছে জামিনে কারামুক্ত জঙ্গিরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমদিকে জঙ্গিরা মাদ্রাসা পড়ুয়াদের টার্গেট করত। এরপর তরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে দলে ভেড়াতে শুরু করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। এ অবস্থায় নতুন নামে জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এখন অল্প শিক্ষিত ও নিু আয়ের মানুষকে টার্গেট করে দলে ভেড়ানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি নির্মূলের কথা বলা হলেও দেশ থেকে উগ্রবাদী অপশক্তি নির্মূল হয়নি। নানা পরিচয়ে, নানা কৌশলে তারা নেটওয়ার্ক বিস্তারের চেষ্টা করছে। মূলত তরুণ-তরুণীদের বেশি টার্গেট করা হচ্ছে। শক্তি সঞ্চয়ের পাশাপাশি তারা নিজেদের ধ্বংস ক্ষমতাও বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

মানবাধিকারকর্মী ও জঙ্গিবিষয়ক বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে শক্ত হাতে জঙ্গিদের দমন করছে, তাতে তাদের বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা আছে বলে আমি মনে করি না। তবে উগ্রবাদী গোষ্ঠী নানা কৌশল অবলম্বন করবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের মতাদর্শগত তৎপরতা থেমে নেই। নতুন নামে এবং কৌশল পরিবর্তন করে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এসব জঙ্গির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক আছে। মনে হয়-নির্বাচনের আগে তারা সক্রিয় হচ্ছে। নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো-নির্বাচনের আগে সহিংসতা করলে নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

জানা গেছে, উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর বেশ কিছু এক্সপার্ট গ্রুপ অনলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রমে সক্রিয় রয়েছে। তারা আইটি (প্রযুক্তি) বিষয়ে অনেক পারদর্শী। বিভিন্ন নামে ওয়েবসাইট-ব্লগ খুলে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে যেসব কন্টেন্ট রয়েছে তার বেশিরভাগ সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমকে উসকে দিচ্ছে। জঙ্গিরা আগে ফেসবুকসহ হাতেগোনা কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত। এখন তারা নিত্যনতুন অ্যাপস ব্যবহার করছে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে তারা চালাচ্ছে উগ্রবাদী প্রচার-প্রচারণা। তাদের শনাক্ত করতে অনেক সময় গোয়েন্দাদের হিমশিম খেতে হয়। দেশের যুবসমাজ বেশিরভাগ সময় সামাজিক মাধ্যমে ব্যয় করে। এই সুবাদে জঙ্গিরা যুবকদের দলে টানার নানা কৌশল অবলম্বন করছে।

জঙ্গি দমনে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইনে তৎপর রয়েছে উগ্রবাদী মতাদর্শের গোষ্ঠী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার প্যাট্রোলিংয়ের কারণে তারা দাওয়াতি কার্যক্রমে একের পর এক কৌশল পালটাচ্ছে। পুরোনো জঙ্গিদের নিয়ে কাজ করা সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুরোনো ও নতুন করে গজিয়ে ওঠা সব নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীরই সাধারণ চরিত্র হচ্ছে-রক্তপাতের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করে ‘ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা’র প্রচারণা। যেটি তারা করে থাকে ধর্মশাস্ত্রের কোনো কোনো অংশের বিকৃত উপস্থাপনের মাধ্যমে। সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জিহাদি মনোভাব উসকে দেওয়ার কাজ করে থাকেন উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা। এই মতাদর্শ প্রচারকারীদের প্রকৃতপক্ষে কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১০ বছরে ৯টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি), ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিজবুত তাহরির ও ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলাকে টিম, ২০১৭ সালের ১ মার্চ জঙ্গি সংগঠন হিসাবে ‘আনসার আল ইসলাম’, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ‘আল্লাহর দল’ এবং সর্বশেষ ৯ আগস্ট নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

একেকটি সংগঠন নিষিদ্ধ করার পর নতুন নামে আবার জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব জঙ্গি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ভার্চুয়ালি (অনলাইন) যুক্ত। এভাবে আগামী দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ইসলামী জঙ্গিদের তৎপরতা বাড়ছে। জঙ্গিরা রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার হতে পারে বলে মনে করছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

সম্প্রতি তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ (আল-জিহাদি) নামে দেশে আরও একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। উগ্রবাদী এই সংগঠনটির প্রধানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন-জুয়েল মোল্লা (২৯), রাহুল হোসেন (২১) ও গাজিউল ইসলাম (৪০)। গ্রেফতারের পর এটিইউ জানতে পারে, তারা ২০২৪ সালে দেশে বড় ধরনের নাশকতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই দলের এক জঙ্গি অর্থায়নের জন্য নিজের জমি এবং বাড়ি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল। এর আগে আগস্টে মৌলভীবাজার এলাকায় অভিযানে গিয়ে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে আরেকটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পায় ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। সেখান থেকে গ্রেফতারও করা হয় বেশ কয়েকজনকে।

পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট-এটিইউর ডিআইজি (অপারেশনস) আলীম মাহমুদ জানান, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা পুরোনো কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। তারা ফেসবুক, ইউটিউবে বক্তব্য প্রচার করে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে সদস্য সংগ্রহ করছিল। তাছাড়া মানুষের মনে ভীতি তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছিল। তিনি জানান, সদস্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি তারা অর্থও সংগ্রহ করছিল। এই অর্থ দিয়ে তারা অস্ত্র কেনাসহ বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল। তিনি বলেন, অনলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা রুখতে নিয়মিত সাইবার প্যাট্রোলিং করা হচ্ছে।

এটিইউর পুলিশ সুপার (অপারেশনস) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, জুয়েল মোল্লা মূলত নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য ছিলেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি ৯ মাস কারাগারে ছিলেন। এই সময়ে কারাগারে বসেই নিজের একটি সংগঠন করার পরিকল্পনা করেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য জসীম উদ্দিন রহমানির বক্তব্যে মূলত উদ্বুদ্ধ হন জুয়েল। রহমানি বর্তমানে কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। রহমানিকেও কারাগার থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল জুয়েলের। জেল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন উগ্রবাদী সংগঠন গঠন করেন। ইতোমধ্যে এই সংগঠন শতাধিক সদস্য সংগ্রহ করেছে।

ডিএমপির সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জেএমবি এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। জেএমবির একজন শীর্ষ নেতা পলাতক থেকে পুরোনোদের সংগঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। জঙ্গি অপতৎপরতা সম্পর্কে সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো সতর্ক ও সজাগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা সুবিধা করতে পারছে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম