আইএমইডির প্রতিবেদন
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতি
আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়লেও উদ্বেগজনক হারে কৃষি শ্রমিক কমেছে। ১৫ বছরে দেশে ধান, আলু, ভুট্টা, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ফলে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিকের চাহিদা বাড়লেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসল আহরণে অপচয় কমানো, উৎপাদন বৃদ্ধি, আহরণের সময় বাঁচানো এবং মুনাফা নিশ্চিত করা। এ প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকিমূল্যে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। সরকার ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্পটি নিয়ে ৩০ জুন নিবিড় পরিবীক্ষণ করে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তৃতীয় পক্ষ হিসাবে ডেভেলপমেন্ট টেকনিক্যাল কনসালট্যান্টস প্রা. লিমিটেডের (ডিটিসিএল) মাধ্যমে এ মূল্যায়ন করা হয়। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নির্দেশনা না মানা, কারিগরি কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা তথা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা, বাজারদর যাচাই না করে উচ্চদরে কৃষিযন্ত্র কেনা, নিুশক্তির (হর্স পাওয়ার) কৃষিযন্ত্র সংগ্রহ তথা কেনা ও কৃষকদের সরবরাহ করা, নিুমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা সত্ত্বেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ করা, কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং প্রকল্পের বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার মতো অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, আইএমইডির প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তারা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে তারা যেভাবে লিখেছে, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রতিটি নতুন কাজে দুর্বলতা থাকেই। যারা মেশিনারিজ সরবরাহকারী, তারা বিক্রয়-পরবর্তী সেবা প্রদানে কিছু অনিয়ম করেছে। তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রিুতি নিয়েছি। এখন তারা সেবা দিচ্ছেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সার্বিক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। কৃষক, সরবরাহকারী, সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির মডেল, মূল্য, সেবা, সেবাদানকারীসহ যাবতীয় বিষয়ের ডেটাবেজ করা হচ্ছে। আগামী দিনে সার্বিক দুর্বলতা কমে আসবে।
সম্প্রতি প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগ আমলে নিয়ে তা তদন্তের জন্য দুদক নথি পাঠায় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় অভিযোগ তদন্তে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। তবে কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি বলে জানা গেছে। কথা ছিল উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেকানিক তৈরি করা হবে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে জেলা পর্যায়ে একজন করে প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রকৌশলীরা মেকানিকদের নির্দেশনা দেবেন।
বিড়ম্বনায় পড়া কৃষকদের অভিযোগ, সরকার তাদের ভর্তুকিমূল্যে কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করেছে। বিক্রয়োত্তর সেবাও সরকারকে দিতে হবে। ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য এসিআই মোটরস লিমিটেড, গ্রিনল্যান্ড টেকনোলজিস লিমিটেড ও এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ৩৪ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষক সেবা পাচ্ছেন না। প্রকল্পের আওতায় সরকারের নিয়োগকৃত সরবরাহকারীর কাছ থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার ৩ বছর বিক্রয়োত্তর সেবা পাবেন গরিব কৃষক। কম্বাইন হারভেস্টার, পাওয়ার থ্রেসার ও রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মতো যন্ত্রপাতির জন্য কৃষক এক বছরের ওয়ারেন্টি পাবেন। যন্ত্রের ত্রুটি শনাক্ত করে তা মেরামতের বিষয়টি ওয়ারেন্টিতে অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু আইএমইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৭৪ শতাংশ কৃষক অভিযোগ করেছেন, ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্যদের তালিকায় নাম ওঠাতে তারা অসুবিধায় পড়ছেন। প্রায় ৪৩ শতাংশ কৃষক বলেছেন, তারা অর্থ দেওয়ার পরও যন্ত্রপাতি পেতে বেগ পেয়েছেন। প্রায় ৬ শতাংশ কৃষকের দাবি, তারা নিুমানের সরঞ্জাম পেয়েছেন। ৩২ জেলার ১ হাজার ৮২৪ কৃষকের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইএমইডি।
হাওড় ও উপকূলীয় এলাকার ৭০ শতাংশ এবং সমতলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি গরিব কৃষকদের দেওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছেন অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি ও স্থানীয় দালাল। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুস, যন্ত্রের দাম বাড়িয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়, ভুয়া উপকারভোগী বানিয়ে পুরো যন্ত্রের টাকা আত্মসাৎ, প্রকৃত কৃষকের বদলে অন্যকে যন্ত্র দেওয়া, মানহীন যন্ত্র সরবরাহ, যন্ত্র বিতরণে প্রভাবশালীদের প্রভাব, নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র কয়েকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ রয়েছে নানা অভিযোগ।
প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর অনিয়মের বিষয়ে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছে। যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে। ভর্তুকি দরে যন্ত্র কেনার জন্য কৃষকের আবেদনের পর খসড়া তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা বাছাই কমিটি। বাছাই কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কৃষি কর্মকর্তা সদস্য সচিব। এছাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কমিটিতে রয়েছেন। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের পর উপকারভোগী কৃষকদের প্রত্যয়নপত্র দেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। ভর্তুকি বাদে বাকি টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে কৃষক ডিলারের কাছ থেকে যন্ত্রটি সংগ্রহ করেন।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নতুন কোনো কাজ করতে গেলে ভুলত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। ইচ্ছা করে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। আমার আগে যিনি প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, এগুলোর বেশির ভাগই তার সময়ে দেওয়া আপত্তি। তিনি হয়তো এগুলো খেয়াল করেননি। আমি দায়িত্বে আসার পর এগুলো নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি।