গ্রামের ৩৫ টাকার ডাব ঢাকায় ১৮০ টাকা
ইয়াসিন রহমান, ঢাকা ও কামরুল হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গু রোগীদের পানিশূন্যতা পূরণে বেড়েছে ডাবের চাহিদা। একে কেন্দ্র করে ডাব বিক্রিতে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে। অতি মুনাফা করতে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে দাম। গ্রামের বাগানে প্রতি পিস ডাব ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও রাজধানীতে খুচরা পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বড় আকারের প্রতিটি ডাব ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। ফলে একদিকে কম মূল্যে ডাব বিক্রি করে বাগান মালিকরা ঠকছেন, অন্যদিকে বাড়তি টাকা খরচ করে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তা।
উৎপাদক ও স্থানীয় পাইকারদের অভিযোগ, কম মূল্যের ডাব আড়তে গেলেই দাম বেড়ে যায়। ছোট, মাঝারি ও বড়-এই তিন আকারে দর নির্ধারণ করেন আড়তদাররা। তাদের হাতবদলে ঢাকায় ডাবের দাম হচ্ছে আকাশচুম্বী। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজধানীর আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই শত শত ডাব ঢাকায় আসছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলা থেকেও প্রচুর ডাব ঢাকায় আসে। বাগান থেকে স্থানীয় পাইকাররা প্রতি পিস ডাব ৩৫-৪০ টাকায় কিনে নেন। পরে গাছ থেকে ডাব নামানো ও পরিবহণ করে রাজধানীর ওয়াইজঘাটের আড়ত পর্যন্ত নিতে প্রতি পিস ডাবে ২৫ টাকার মতো খরচ হয়। সেক্ষেত্রে আড়ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পাইকারদের প্রতি পিস ডাবে খরচ হয় ৬০-৬৫ টাকা। আড়তদারদের সিন্ডিকেট যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেই দামই তাদের নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে আড়তদাররা প্রতি পিস ডাব ১০০-১৫০ টাকায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর খুচরা বিক্রেতারা সেই ডাব পিসপ্রতি ১৫০-১৮০ টাকায় বিক্রি করে।
রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারে বুধবার ডাব কিনতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. আকরাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার দুই মেয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। প্রতিদিন ওদের জন্য দুটি করে ডাব কিনতে হচ্ছে। আজ একটি ১৫০ এবং আরেকটি ২০০ টাকায় কিনেছি। প্রতিদিন এত দামে ডাব কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
একই দিন রাজধানীর নয়াবাজারেও প্রতি পিস বড় আকারের ডাব ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রতিটি পণ্য নিয়ে সিন্ডিকেট চক্র গড়ে উঠছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে ডাবের চাহিদা বাড়ায় এই পণ্যটিও বেশি দামে বিক্রি করছে অসাধু চক্র। তদারকি সংস্থার কাছে তথ্য আছে কারা দাম বাড়াচ্ছে। অসাধুরাও চিহ্নিত। এরপরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না। ফলে অসাধুরা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর ইউনিয়নের মাদারবুনিয়া গ্রামের একটি বাণিজ্যিক নারিকেলবাগানে যান যুগান্তর প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় বাগান মালিক জহির হোসেন ও ইমরানের সঙ্গে। তারা যুগান্তরকে বলেন, পাইকারের মাধ্যমে আমরা ডাব বিক্রি করি। তারা এসে গাছ থেকে ডাব কিনে নেয়। আমাদের বাগানের প্রতি পিস ডাব ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি করি। শুনছি এই ডাব ঢাকায় ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে ভোক্তাদের সঙ্গে আমরাও প্রতারিত হচ্ছি।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এখানকার মাটি ও জলবায়ু নারিকেল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। বসতবাড়ি ও বাণিজ্যিকভাবে স্থাপিত বাগানে এই ডাব-নারিকেল উৎপাদন হয়ে থাকে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রতিদিনই প্রায় দুই হাজার ডাব ঢাকায় নেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে মাঠ পর্যায়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় ডাব বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ডাবের মূল্য কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ডেঙ্গু বিস্তারের সুযোগ নিয়ে হঠাৎ করেই ডাবের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। অসহায় রোগীদের জিম্মি করে ডাব ব্যবসায়ীদের এই অতিমুনাফা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ২৪ আগস্ট গভীর রাতে কাওরান বাজার আড়তে অভিযান পরিচালনা করে অধিদপ্তর। সেখানে পাইকারি পর্যায়ে ডাবের সর্বোচ্চ মূল্য প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৭০ টাকায় পাওয়া যায়। অর্থাৎ সবচেয়ে ভালোমানের ডাব খুচরায় সর্বোচ্চ ১০০ টাকার বেশি হতে পারে না বলে দাবি করে অধিদপ্তরের তদারকি টিম। পাশাপাশি তারা জানান, ডাবের কেনাবেচায় কোনোরকম ক্রয়-বিক্রয় রসিদ রাখা হয় না। এ সুযোগে ডাবের আড়তে পাইকারি, খুচরা প্রতিটি স্তরে মূল্যবৃদ্ধির এক মহোৎসব চলছে। ডাবের মূল্য নিয়ে সম্প্রতি সভা করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। সেসময় তিনি বলেন, ৪০০ টাকা দিয়ে বাংলাদেশে দুটি ডাব কিনতে হবে, আমরা কি সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছি? ডেঙ্গুকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা প্রতিটি বাজারে ভোক্তাকে জিম্মি করছে। এভাবে চলতে পারে না। তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যতক্ষণ না ডাবের খুচরা মূল্য ১০০ টাকায় আসবে, আমরা ততক্ষণ মনিটরিং জোরদার রাখব। অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনব।