Logo
Logo
×

শেষ পাতা

এনবিআর’র নারী যুগ্ম কমিশনার অপহরণ

ধরাছোঁয়ার বাইরে সাবেক স্বামী হারুন

বেরিয়ে আসছে আরও নাম * হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কাগজপত্রে সই নেয় অফিস পিওন : ভিকটিম

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধরাছোঁয়ার বাইরে সাবেক স্বামী হারুন

অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামি।ছবি: যুগান্তর

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুনকে অপহরণ-নির্যাতন ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেছে। এ ঘটনার মূল হোতা মাসুম ওরফে মাসুদের তথ্য অনুযায়ী, মাসুমার সাবেক স্বামী হারুনুর রশিদের নির্দেশেই এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে হারুন। মাসুমার বর্তমান স্বামী মুহাম্মদ ইলিয়াস খান তমালের অভিযোগ, থানা পুলিশ কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ হয়েছে। এ কারণেই হারুনকে গ্রেফতার করছে না। তবে রমনা থানার ওসি আবুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি খুবই সেনসেটিভ। আমরা চাই না নিরপরাদ কেউ ফেঁসে যাক। তাই নিশ্চিত না হয়ে নতুন করে কাউকে গ্রেফতার করতে চাচ্ছি না।

এদিকে মাসুমার অপহরণের ঘটনায় আরও নাম বেরিয়ে এসেছে। এজাহারভুক্ত আট আসামি ছাড়া আরও যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বিল্লাল হোসেন, আলমগীর, পারভেজ, শাহজালাল প্রমুখ। তাদের মধ্যে বিল্লাল হলেন মাসুমার সাবেক স্বামী হারুনুর রশিদের ভাই। আলমগীর হলেন মাসুমার অফিস পিওন। আর পারভেজ ও শাহজালাল হারুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিল্লাল এর আগে মাসুমাকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করতে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের রুমে দরজা বন্ধ করে মারধর করেছেন। আর মাসুমা হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় তার অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বিভিন্ন কাগজপত্রে সই নিয়েছেন আলমগীর। এরপর থেকে তিনি পলাতক। র‌্যাব, পুলিশ, ভিকটিম এবং মাসুমার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ভিকটিমের স্বজনরা জানিয়েছেন, মাসুমা হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় অপারেশেন থিয়েটারে যাওয়ার আগে তার কাছ থেকে যেসব সই নেওয়া হয়েছে, সেগুলোয় জায়াগা-জমি, ফ্ল্যাট, সহায়সম্পত্তি বা বর্তমান স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র থাকতে পারে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, মামলায় হারুনুর রশিদকে আসামি করা হয়নি। মাসুমার সাবেক গাড়িচালক মাসুদ ওরফে মাসুমকে গ্রেফতারের পর আমরা হারুনের বিষয়ে তথ্য পাই। মাসুদ র‌্যাবকে জানিয়েছে, হারুনই মাসুমাকে অপহরণের নির্দেশ দেয়। এই অপহরণের জন্য মাসুদকে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান মাসুমার সাবেক স্বামী হারুন। মূলত অর্থলোভেই মাসুদের পরিকল্পনায় এই চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনা ঘটে।

মাসুদকে হারুন এই বলে বুঝিয়েছে যে, মাসুমা এবং তার বর্তমান স্বামী ইলিয়াস খান তমাল-দুজনের চরিত্র খারাপ। পরে মাসুমা এবং তমাল দুজন একে অপরের প্রেমে পড়ে যান। এতে হারুনের সোনার সংসার ধ্বংস হয়েছে। এ কারণেই মাসুমা ও তমালকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন হারুন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, মাসুমাকে অপহরণের পর তার বর্তমান স্বামী তমালকেও অপহরণ করতে চেয়েছিলেন চক্রের সদস্যরা। এজন্য হাতিরঝিলে মাইটিভি ভবনের পাশে একটি বাসা ভাড়া করা হয়েছিল। সেখানে এক মহিলাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, ওই বাসায় আগে মাসুমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর তমালকে অপহরণের পর সেখানে নেওয়া হবে। ওই বাসাতেই জোরপূর্বক তমালকে দিয়ে মাসুমাকে ডিভোর্স দেওয়া হবে। কিন্তু অপহরণকারীদের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই কৌশলে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পান মাসুমা।

সূত্র জানায়, মাসুমা এবং বর্তমান স্বামী তমাল ক্লাস ফ্রেন্ড। তারা দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দুজনের পরিচয় না থাকলেও পরে পরিচয় হয়। এই সুবাধে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এদিকে ১০-১২ বছর ধরে মাসুমার সঙ্গে হারুনের বনিবনা হচ্ছিল না। কয়েক মাস

২০২২ সালের ২২  ফেব্রুয়ারি মাসুমা এবং তমাল গোপনে বিয়ে করেন। তমাল তেমন কোনো অর্থসম্পদের মালিক না। অন্যদিকে হারুন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। এই সম্পদের অনেক কিছুই মাসুমার নামে। হারুনের ধারণা, তিনি মাসুমাকে যেসব সম্পত্তি দিয়েছেন, সেগুলো আর ফেরত পাবেন না। তমালই সেগুলো ভোগ করবেন। এ কারণে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদের পরিকল্পনা করেন হারুন।

মাসুমা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, আমাকে যেদিন অপহরণ করা হয়, এর পরদিন অর্থাৎ ১৮ আগস্ট থানায় জিডি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই ওই জিডির খবর চলে যায় অপহরণকারী চক্রের কাছে। এ কারণে চক্রের সব সদস্য তাদের মোবাইল ফোন এবং সিমকার্ড ফেলে দেয়। তবে ব্যতিক্রম ছিল মাসুদ। তার ফোন খোলাই ছিল। আমাকে উদ্ধার করার পরও টানা তিন দিন সে আমার স্বামীকে বারবার ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়েছে। মাসুমা বলেন, আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, তখন স্বামী তমাল আমার সঙ্গে ছিল। এ সময় একদিন আসামিরা হাসপাতাল পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। ওইদিন তমাল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বেঁচেছে। তিনি বলেন, অপহরণকারীরা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে টর্চার সেল ভাড়া করেছিল।

মাসুমা বলেন, আমি হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আমার অফিস পিওন আলমগীর ৫-৬টি কাগজে সই করিয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, অপারেশনের জন্য সই লাগবে। আমি তখন মারাত্মক অসুস্থ। যেখানে সই দিতে বলেছে, সেখানেই দিয়েছি। কোনো কিছু দেখা বা পড়ার অবস্থায় আমি ছিলাম না। এখন ধারণা করছি, সে হয়তো আমার ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাজীপুরে প্রায় এক বিঘা জমি এবং ইস্কাটনের দুটি ফ্ল্যাটসহ বেশ সহায়সম্পদ আমার নামে আছে। সেগুলো হারুন ফেরত চায়। পাশাপাশি দ্বিতীয় স্বামীকে ডিভোর্স দিতে বলে। তিনি বলেন, অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় বিল্লাল হোসেন, আলমগীর, পারভেজ এবং শাহজালালসহ অনেকেই জড়িত। বিল্লাল ফেব্রুয়ারিতে রমনা থানার ভেতর পুলিশের সামনেই আমাকে মারতে উদ্যত হন। গত ঈদের দুই দিন আগে আমি বারডেম হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলে সেখানে রোগীর রুমের দরজা বন্ধ করে হারুনের সামনেই তিনি আমাকে মারধর করেন। এর আগে একবার আমার গাড়ি ভাঙচুর করেছে। হারুনের টাকাতেই তিনি বাড়িতে একটি তেতলা আলিশান ভবন বানিয়েছেন। আমার মায়ের জমি দখল করে যাত্রাবাড়ীতে দ্বিতল ভবন তৈরি করেছেন বিল্লাল। প্রতিবাদ করায় আমাকে চাপাতি নিয়ে আঘাত করতে এসেছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৮ আগস্ট রাত সোয়া ৮টার দিকে রমনা ধানাধীন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে নিজ গাড়িসহ অপহৃত হন কর কর্মকর্তা মাসুমা খাতুন। পরদিন বেলা ২টার পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কৌশলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে রক্ষা পান। এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অপহরণকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। পরে র‌্যাব আরও তিন আসামি গ্রেফতার করে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম