উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ
গণহত্যার বিচার দাবি ও দেশে ফেরার আকুতি
আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘আমরা দাঁড়িয়ে আছি গণহত্যার সাক্ষী হিসেবে। সেই মর্মান্তিক দিনগুলোর ছয় বছর পার হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, ন্যায়বিচারের পথ এত কঠিন কেন? যত দিন যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থা কমছে। তাদের প্রতি আমাদের আবেদন, সবার প্রচেষ্টাকে একত্রিত করে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করুন। কার্যকর পদক্ষেপের সময় এখনই।’ ছয় বছর আগে ঘটা গণহত্যার বিচার ও নিজ দেশে ফেরার দাবিতে শুক্রবার উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আয়োজিত সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা এ কথা বলেন। সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাখো রোহিঙ্গা এসব সমাবেশে যোগ দেন। সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে। সমাবেশগুলো থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিচার ও বাপ-দাদার ভিটায় ফেরার দাবি জানানো হয়।
সমাবেবেশগুলোতে ইংরেজিতে লেখা লিফলেট বিলি করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, আজ আমরা রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসের ষষ্ঠ বার্ষিকী পালনে জড়ো হয়েছি। সেই ট্র্যাজেডির ক্ষণগুলো আমাদের খুব বেশি তাড়া করে চলেছে। এই দিনটি ব্যাপক ক্ষতি, দুর্ভোগ এবং অকল্পনীয় নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা নতমস্তকে বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, এমন কঠিন সময়ে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় জন্য।
বক্তব্যে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, এই দিনে বর্বরতার ভয়ঙ্কর দৃশ্য মনে পড়ে। আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হয়। অগণিত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়। আমাদের গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। তবে আমাদের আশাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, আসিয়ান বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় নোঙর করেছে। আমরা আসন্ন গ্রীষ্মের মধ্যে নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তাসহ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।
তারা আরও বলেন, ‘একদিন আরাকানের দিকে রোডমার্চ এবং সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারে ফিরে যাব আমরা। এ দিনটিতে আমাদের কণ্ঠস্বর যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠুক। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এমন একটি বিশ্বের জন্য পথ প্রশস্ত করুক যেখানে এ ধরনের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি না হয় এবং যেখানে সব সম্প্রদায় শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারে।’
রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবায়ের বলেন, ‘সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসন চাই। আমাদের আশা সমাবেশে উত্থাপিত রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গুরুত্ব পাবে। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মূল দাবি সম্মান ও মর্যাদার সাথে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, আমরা এজন্য কৃতজ্ঞ।’
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, এই দিনটিতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। আর ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত এপিবিএন অধিনায়করা জানান, রোহিঙ্গারা নিজেদের দাবি নিয়ে সুশৃঙ্খল সমাবেশ করেছেন। ক্যাম্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন দেখানো নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মহাসমাবেশ হয়। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তের গুলিতে তিনি নিহত হন। ২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই শুরু করেছিলেন ‘গুয়িং হোম’ ক্যাম্পেইন। কিন্তু প্রত্যাবাসনবিরোধী রোহিঙ্গাদের একটি চক্র ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনার পর এ ধরনের সমাবেশে একক কোনো আয়োজক কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ সামনে আসছেন না। তবে প্রচারপত্রে আয়োজক হিসেবে ‘নির্যাতিত সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ লেখা হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে পালিয়ে আসে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। সরকারি হিসেবে এদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের উখিয়ার টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়। তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বিশাল বনভূমি হারিয়েছে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আনাগোনায় উখিয়া-টেকনাফ পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসের জনপদে। ফসলের জমি বিনষ্ট, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা কারণে দিন দিন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন আর অস্ত্রের মহড়া বেড়েই চলেছে। আধিপত্য বিস্তারে আরসা-আরএসও’র পক্ষ হয়ে কয়েকটি গ্রুপ প্রায়ই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। মাদক কারবারসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড জিইয়ে রাখতে নবী হোসেন গ্রুপ, আরসাসহ সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রত্যাবাসন ঠেকাতে তৎপর। তাই তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে খুন ও নাশকতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।