দ্বার খুলছে চার মেগা প্রকল্পের
উদ্বোধন ঘিরে তোড়জোড়
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বার খুলছে দেশের আলোচিত চার মেগা প্রকল্পের। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যেই উদ্বোধন ঘিরে চলছে তোড়জোড়। দুই মাসে একে একে চালু হবে বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৭৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
যদিও প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৫৪ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। পরে ১৯ হাজার ৬৭০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কোনো কোনো সাইটে রাত-দিন চলছে কাজ। লাগানো হয়েছে অতিরিক্ত শ্রমিক। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্পর্ক না থাকলেও নির্বাচনের আগে চালু হওয়াতে জনগণের জন্য সরকারের উপহার হিসাবে কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে সম্পন্ন হয়েছিল। এখন উদ্বোধন হচ্ছে জেনে খুবই আনন্দ হচ্ছে। এর সুফল জনসাধারণই ভোগ করবেন। তাই এখানে নির্বাচন বড় কথা নয়। আমাদের সরকার প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছে এবং বাস্তবায়নও করেছে। ফলে ভোটের রাজনীতিতে জনগণ অবশ্যই আমাদের কাজের মূল্যায়ন করবে। উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর উপর দিয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফার্মগেট পর্যন্ত খুলে দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর এ অংশের উদ্বোধন করা হবে বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সরেজমিন দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কবাতি লাগানো শেষ। পিচ ঢালাই চলছে।
উড়ালসড়ক থেকে নামার র্যাম্প নির্মাণের কাজও শেষের পথে। সেই সঙ্গে বনানীর বিভিন্ন স্থানে টোল প্লাজা এবং ওজন স্কেল বসানো প্রায় শেষ। চলছে সংলগ্ন রাস্তা তৈরির কাজ। এখানে রাত-দিন কাজ করছেন শ্রমিকরা। বাড়তি শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় এ পর্যন্ত যত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি সবচেয়ে বড়। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এছাড়া মূল উড়ালসড়কে উঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প থাকবে।
এসবসহ মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ২০২৪ সালের জুনে পুরো প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ২৪১৩ কোটি ৮৪ লাখ এবং বাকি টাকা নির্মাতা কনসোর্টিয়ামের।
রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ উদ্বাধন করা হবে ২০ অক্টোবর। জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পটির উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে নির্মিত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত শতভাগ কাজ শেষ হয়ে ট্রেন চলাচল করছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৯৬ দশমিক ১০ শতাংশ। সরেজমিন প্রকল্পটির আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ ঘুরে দেখা যায়, উপরের ভায়াডাক্টসহ সিস্টেম স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।
নিচের দিকে স্টেশনগুলোর সিঁড়ি, এস্কেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি), টিকিট কাউন্টার এবং সাইড রোডের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে ফাইন টিউনিংও। এ সময় কর্মরত এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, ৭ জুলাই এই অংশে ট্রায়াল রান হয়েছে। সে সময় লোড বেশি দিয়ে ট্রেন চালানোর পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ বিজয় সরণি এবং কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার ওপরে স্প্যানের দূরত্ব ৩০ ফুট রয়েছে। যেটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এজন্য লোড দিয়ে দেখা হয়েছে রেলপথ কতটা ব্যান্ড (বেঁকে) হয়।
এরপর এখন চলছে সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের পরীক্ষা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। পরে কমলাপুর পর্যন্ত নতুন অংশ যোগ করায় ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এদিকে ২৮ অক্টোবর জনসাধারণের চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু টানেল। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, কর্ণফুলীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী এর
আগে যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত টানেলের কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। চলছে শেষ সময়ের কার্যক্রম। আশা করছি ডেডলাইন অনুযায়ীই প্রকল্পটি উদ্বোধন করা সম্ভব হবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এটি চালুর মধ্যদিয়ে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে অনুমোদনের দুই বছর পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কাজ আটকে যায়। এটির নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।
তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে টানেলের টিউব দুটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। এটির ‘সাউথ টিউব’ দিয়ে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রাম শহরে এবং উজানের দিকের ‘নর্থ টিউব’ দিয়ে চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমির দিক থেকে আনোয়ারার দিকে যানবাহন চলাচল করবে। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পের শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। অনুমোদনের দুই বছর পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা করা হয়।
৭ অক্টোবর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্প। এটি পূর্ণাঙ্গ চালু হলে বছরে সেবা পাবেন প্রায় এক কোটি ২০ লাখ যাত্রী। ইতোমধ্যেই টার্মিনালটির নির্মাণকাজ ৮২ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক একেএম মো. মাকসুদুল ইসলাম এর আগে যুগান্তরকে বলেন, কাজ চলছে আশা করছি যথা সময়েই শেষ করা যাবে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে কি কি কাজ চলছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, উদ্বোধন ঘিরে প্রতি সপ্তাহে ১১-১২ হাজার কর্মী দিন-রাত কাজ করছেন এ প্রকল্পে।
২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং কোরিয়ার স্যামসাংয়ের এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) এ টার্মিনালের নির্মাণকাজ করছে। এটি নির্মাণে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেবে এবং বাকি অর্থ দেবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। শাহজালালে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুই টার্মিনালের আয়তন এক লাখ বর্গমিটার। তৃতীয় যে টার্মিনালটি হচ্ছে, সেটির আকার বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। এটির আয়তন হবে দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার।