সাইবার নিরাপত্তা আইন
আগের মামলায় দোষী হলে সাজা নতুন আইনে
সাজা ও জরিমানা কমানো হয়েছে : আইনমন্ত্রী * ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কথা স্বীকার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনায় নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাজা ও জরিমানা কমানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি জানান, অনেক ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। নতুন আইনের সমালোচনাকারীরা না বুঝে সমালোচনা করছেন। নতুন আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমাতে নয়, সাইবার অপরাধ কমাতে প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা হয়েছে, ওইসব মামলায় কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাকে ওই আইনে সাজা না দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাজা দেওয়ার বিষয়ে আদালত যেন বিবেচনা করেন, সেই পদক্ষেপ নেব।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক উপস্থিত ছিলেন। নতুন আইনের ওপর ১৪ দিন মতামত দেওয়া যাবে বলেও জানানো হয়।
সরকার সোমবার সাইবার নিরাপত্তা আইন অনুমোদন দেয়। নতুন এ আইন নিয়েও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলছে। ওই সমালোচনার মধ্যে বুধবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওয়েবসাইটে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়। একইসঙ্গে এ আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আইন মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়-১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য। আর ধারা ১৮(১)(খ), ২০, ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৬ নম্বর ধারা অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য।
আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরুতে এর কিছু অপব্যবহার দেখতে পাই যা আমি অকপটে স্বীকার করতে কখনই কুণ্ঠাবোধ করিনি বা করব না। সে সময়ে এ আইনের অপব্যবহার রোধে আমরা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করি। ফলে এ আইনের অপব্যবহার অনেকটাই কমে। শেখ হাসিনার সরকার চায় আইনের যেন কোনো অপব্যবহার না হয়। সে কারণেই আমরা সাইবার নিরাপত্তা আইন করি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার কী হবে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ওইসব মামলা চলা বা না চলার বিষয়ে এখনই মন্তব্য করব না। অনেক মামলা তদন্তাধীন আছে। অনেক মামলা কোর্টে আছে। এটা সাবজুডিশ (বিচারাধীন) বিষয়। এখানে আইনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, অপরাধ যে সময়ে হয়েছে, তখন যে আইন ছিল সেই আইনে তাকে সাজা দিতে হবে।
৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, পরবর্তীতে আইনে যদি সাজা বাড়ানো হয়, তবে তা ওই ব্যক্তির ওপর পড়বে না। কারণ যখন যে অপরাধ করেছে তখনকার আইনে সাজা দিতে হবে। নতুন আইনে সাজা কমানো হলে সেটা প্রয়োগ করা যাবে না এমন বিধিনিষেধ সংবিধানে নেই। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা হয়েছে, সেখানে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাকে যেন ওই আইনে সাজা না দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাজা দেওয়ার বিষয়ে আদালত বিবেচনা করেন, সেই পদক্ষেপ নেব।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনায় নতুন আইনে সাজা অনেক কমানো হয়েছে দাবি করে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অপব্যবহার হয়েছিল, নতুন আইন পাশ হলে তা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, বুধবারের আগে নতুন আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়নি। আগের আইনের ২৯ ধারায় মানহানির মামলায় কারাদণ্ড ছিল, বর্তমানে সেটা নেই।
এখন শুধু জরিমানার বিধান করা হয়েছে। তাহলে এটা কি পরিবর্তন নাকি একই জিনিস? ২১ ধারায় জেল ছিল ১০ বছর। এখন হয়েছে ৭ বছর। এটা কি পরিবর্তন না? আইনের সব জায়গায় দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে যে উপধারা ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। এগুলো কি পরিবর্তন না? এরপরও কেউ যদি বলে, নতুন বোতলে পুরান মদ। তাহলে আমাদের বলতে হবে, সমালোচনার জন্যই সমালোচনা করা হচ্ছে, জেনে সমালোচনা করা হচ্ছে না।
সাইবার আইনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য সাইবার অপরাধ বন্ধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনার অপরাধী ধরা হলে ৩৭৯ ও ৩৮০ ধারার আওতায় আনতে পারব না। কারণ তিনি সশরীরে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে চুরি করেননি। তাকে ধরতে হলে সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন। কারণ পেনাল কোডে সশরীরে অপরাধ সংঘটনের কথা বলা আছে।
নতুন আইনের কয়েকটি ধারা জামিনযোগ্য করা হতে পারে-এমন আভাস দিয়ে আনিসুল হক বলেন, শুধু ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারা অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে আমি এটা বলছি না যে যেসব ধারা অজামিনযোগ্য প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর কিছু জামিনযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে যেগুলো জামিনযোগ্য আছে, সেগুলো জামিনযোগ্যই থাকবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সাইবার নিরাপত্তা আইনেও নেই। সংবিধানে বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে তা আমরা রেখেছি। সাইবার অপরাধসংক্রান্ত বিষয়গুলো ১৭, ১৯ ও ৩৩ ধারায় কঠোরভাবে রেখেছি। এগুলো আমরা সাজার আওতায় কঠিনভাবে রেখেছি।
নাগরিকের ডিভাইস চেক করা ব্যক্তিগত গোপনীতা লঙ্ঘন কিনা এবং ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আইনবহির্ভূতভাবে কেউ যদি কারও ডিভাইস চেক করে এবং সেটা যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করা যায় এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা হয়।
তিনি বলেন, আইনবিরোধী কোনো কাজ করলে পুলিশকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা আইনে নেই। নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যার ঘটনায় র্যাবের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার বিচার হয়েছে।
নতুন আইনের কয়েকটি ধারায় পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেফতারে আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা নাগরিক অধিকার পরিপন্থি কিনা-জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, টেকনিক্যাল অপরাধের যেসব ধারা জামিনযোগ্য নয়, সেসব ধারায় গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে।
ওই ব্যক্তি আদালতে তার বক্তব্য দিতে পারবেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সেই মামলায় যিনি ভুক্তভোগী হন, তার ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকারের বিষয়ে কিছু বিধান সাইবার নিরাপত্তা আইনে রাখব।
আইন ও বিচার বিভাগের সচিব গোলাম সরোয়ার বলেন, আমলযোগ্য অপরাধে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি করতে পারবেন। অ-আমলযোগ্য ধারায় তল্লাশি করার কোনো সুযোগ নেই। নতুন আইনে পুলিশের ক্ষমতা অনেক কমানো হয়েছে। অ-আমলযোগ্য ধারায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি করতে পারবে না।
সরকারি কর্মকর্তাদের সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের বিধান নতুন আইনে তুলে দেওয়া সরকারি চাকরি আইনের পরিপন্থি কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে কাজ করেছেন বলে ডিফেন্স নিয়ে নেন, যাতে সেই ডিফেন্স না নিতে পারেন সেজন্য ওই ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি চাকরি আইন বিদ্যমান আছে।