নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসন সাজাচ্ছে সরকার
রুটিন এই রদবদলের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই-সিনিয়র সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় * অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে প্রশাসন সাজিয়ে লাভ হবে না-আলী ইমাম মজুমদার
আমিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে। ৩ মাসের ব্যবধানে চারজন বিভাগীয় কমিশনার ও ৩১ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনে ১৬ জন ডিআইজি, ৩৪ জন অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ২৪ জেলার এসপি পদে রদবদল করা হয়েছে।
এছাড়া মঙ্গলবার পর্যন্ত ৮৫ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ রদবদল নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন, ভোটের আগে ‘পছন্দ’র লোকজন দিয়ে প্রশাসন সাজাচ্ছে সরকার। আবার কেউ বলছেন, রদবদল একটা রুটিন কাজ। এর সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার এবং ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করেন। অর্থাৎ নির্বাচনে ডিসি, এসপি, ইউএনও ও থানার ওসিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এছাড়া সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং অফিসারে দায়িত্ব পালন করেন। আর স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা পোলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকেন।
এছাড়া নির্বাচনি আচরণবিধি দেখভালের জন্য ক্ষমতা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কারণেই নির্বাচনের আগে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে রদবদলকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এ দেশের একজন নাগরিক। সেই হিসাবে দেশকে নিয়ে আমার একটি ভাবনা আছে।
কথা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনটা কেমন হবে। যদি ২০১৪ কিংবা ২০১৮ স্টাইলে হয় তাহলে প্রশাসন নিয়ে কোনো ভাবনার বিষয় নেই। সরকার যা চাইবে ফল তাই হবে। আর যদি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়, তখন দলবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে; যারা পক্ষপাতহীন ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।’
আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, যাদের বদলির সময় হয়েছে তাদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মধ্যে যারা এডিসি হবেন তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব রদবদলের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। রদবদল প্রশাসনের রুটিন কাজ। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী কিংবা সচিবদের পিএস থেকে কেন ডিসি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন হলো; এর বাইরে থেকে কি দেওয়া যেত না-
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রীদের পিএস হিসাবে মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার ডিসি হিসাবে নিয়োগের আগেও একবার তাদের যোগ্যতা যাছাই করা হয়। সুতরাং তারা মেধাবী এবং বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা। তাই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের দাবি করার সুযোগ নেই।
সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘২০১৮ সালে মন্ত্রীদের জন্য মেধাবী কর্মকর্তা বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা যোগ্য অফিসার। সে কারণে তারা নিয়োগ পেয়েছেন। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ার দাবি অবান্তর।’
সাবেক সচিব হাবিবুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের একটা পছন্দ থাকে এটা সত্যি। সে অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনে নিয়োগও হয়। তবে ডিসি নিয়োগের আগে ফিটলিস্ট করা হয়। সেখানে সবাইকে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হয়। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেই ডিসিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আবার আমলাদের অনেকেরই সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এগুলো আমাদের প্রশাসনের সমস্যা।’
এবার ডিসি পদে নিয়োগ নিয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। নতুন ডিসিদের মধ্যে আটজনই বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব (পিএস)। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ১১ জনকে জেলা প্রশাসক করা হয়েছে। ডিসি পদে ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তাদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২৪ ও ২৫তম বিসিএসের অল্প কিছু কর্মকর্তাও ডিসি হিসাবে মাঠে আছেন। তবে সবাই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন এমন নয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মু. আসাদুজ্জামানকে পাবনা, আইনমন্ত্রীর পিএস নূর কুতুবুল আলমকে পটুয়াখালী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর পিএস আরিফুজ্জামানকে ভোলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পিএস খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমানকে কুমিল্লা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিনকে বান্দরবান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পিএস কায়ছারুল ইসলামকে টাঙ্গাইল, নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রীর পিএস মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদারকে যশোরে এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পিএস মো. গোলাম মওলাকে নওগাঁ জেলার ডিসি করা হয়েছে। মাগুরার ডিসি আবু নাসের বেগ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের মেয়ের জামাই।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যারা কর্মরত, তাদের সরকার ঘনিষ্ঠ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এসব মন্ত্রণালয় থেকে ১১ জনকে নতুন করে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নতুন বিভাগীয় কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল হোসেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের একান্ত সচিব ছিলেন। তিনি এর আগে খুলনার ডিসি ছিলেন। ৩ মাসে ১৬ জন ডিআইজি, ৩৪ জন অতিরিক্ত ডিআইজিকে বদলি করা হয়েছে। ২৪ জেলায় নতুন এসপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৮৫ উপজেলায় দেওয়া হয়েছে ইউএনও। সাধারণত নির্বাচনে ডিসি, এসপি এবং ইউএনওরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গত বছর ২৯ অক্টোবর ডিএমপির বর্তমান কমিশনার গোলাম ফারুক যোগদানের পর ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ থানার ওসি বদল করা হয়েছে।