ডেঙ্গু নিয়ে বিচারিক অনুসন্ধানের ১০ দফা
সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি চার বছরেও
সংশ্লিষ্ট বেঞ্চটি ভেঙে যাওয়ায় বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়নি -ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
আলমগীর হোসেন
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
এডিস মশা নির্মূলসহ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে হাইকোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি চার বছরেও। রিটকারী আইনজীবী বলছেন, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ মৌসুমেও সেদিকে তাদের নজর নেই। ডেঙ্গু নিয়ে বিচারিক অনুসন্ধানের দশ দফা সুপারিশ কেন আলোর মুখ দেখল না, সেই প্রশ্নটিও ঝুলে আছে। যদিও সংশ্লিষ্ট বেঞ্চটি ভেঙে যাওয়ায় বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
ডেঙ্গু নির্মূলে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করতে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর বিচারিক অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কমিটির অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ সিটি করপোরেশনের হলেও তাদের একার পক্ষে মশা নিয়ন্ত্রণ করা বাস্তবিক পক্ষেই কঠিন। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাজধানীর সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানসহ সবার অংশগ্রহণে সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় এনে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি মশক নিধন কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। কিন্তু গত চার বছরেও সেই সুপারিশ সম্পূর্ণ কার্যকর হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করলে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা বাড়ত না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত যুগান্তরকে বলেন, বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়। এর কিছুদিন পরই করোনাকাল শুরু হয়। যে কারণে আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বতঃপ্রণোাদিত আদেশ প্রদানকারী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তারিক উল হাকিম পদোন্নতি পেয়ে আপিল বিভাগে চলে যান। ফলে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এ কারণে পরে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর আর শুনানি হয়নি।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেছিলেন। বিভিন্ন এক্সপার্টদের নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছে, সিটি করপোরেশনগুলোর নিজেদেরই উদ্যোগী হয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু হঠাৎ করে আসেনি। কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু আমাদের জীবনের ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু অদ্যাবধি এর কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখনো পর্যন্ত তারা চূড়ান্তভাবে বলতে পারল না, আসলে কীভাবে ডেঙ্গু ছড়ায় বা কীভাবে বন্ধ করা যায়। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
‘ডেঙ্গুতে মৃত্যু’ ও ‘রোগী ভর্তি’ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন নজরে এলে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় বিচারিক অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানের সমন্বয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সুপারিশে বলা হয়, প্রতিবছর প্রাক-মৌসুমে তথা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ও পূর্ণ মৌসুমে আবশ্যিকভাবে সিটি করপোরেশন মশার ঘনত্ব বিষয়ে জরিপ করবে। জরিপের ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করে ও প্রচারমাধ্যমে প্রচার করে জনগণকে আগে থেকেই সচেতন করতে হবে। এ ছাড়া প্রতি দুই বছর পরপর মশার ওষুধের (কীটনাশক ও কেমিক্যাল) কার্যকারিতা পরীক্ষা করে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে; ব্যক্তি পর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরি এবং মশক নিধনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথাও বলা হয়েছে সুপারিশে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর যাত্রা ও ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও সিডিসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের আনুষ্ঠানিক প্রাদুর্ভাব ছিল ২০০০ সালে। ওই বছরের পাঁচ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু মহামারি রূপ ধারণ করে ২০১৯ সালে। সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। বছরটিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পুরুষ ৬৩ শতাংশ ও নারী ৩৭ শতাংশ। ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (২৭ শতাংশ) লোকের বয়স ১৫-২৪ বছরের মধ্যে। এক বছরের কম বয়সি ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সি রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম।
কমিটির অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কমিটি ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সুপারিশে বলা হয়, সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত সব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, পুলিশ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ, সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর, রিহাব ও বাড়ি মালিক সমিতি বা কল্যাণ সমিতিসহ সবার অংশগ্রহণে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করা ও জবাবদিহির আওতায় এনে তা বাস্তবায়ন করা। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি মশক নিধন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।